দিনে মাত্র দেড়শো স্যাম্পল নিতে পারছে আইইডিসিআর, ক্রমবর্ধমান চাপ কিভাবে সামলাবে?

Emon Emon

Chowdhury

প্রকাশিত: ১:০১ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৯, ২০২০

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে দেশে এখন পর্যন্ত ৪৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন পাঁচজন। সুস্থ হয়েছেন ১১ জন। এ পর্যন্ত মোট স্যাম্পল পরীক্ষা করা হয়েছে এক হাজার ২৬ জনের। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষা করা হয়েছে ১০৬ জনের। সাধারণের মাঝের অভিযোগ উঠছে অনেক করোনা রোগীই পরীক্ষা করার সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে জানা যাচ্ছে না করোনা আক্রান্ত রোগীর সঠিক পরিমাণ।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, প্রতিদিন প্রায় দেড়শ’ নমুনা সংগ্রহ করতে পারছেন তারা। তবে দিনে তিনশ’ নমুনা সংগ্রহের পাশাপাশি তাদের কয়েক হাজার নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা রয়েছে। তবে এ সক্ষমতাকে যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই সংখ্যাকে অপ্রতুল মনে করছে। আর তাই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা চালুর।

এ প্রসঙ্গে আইইডিসিআর’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর  বলেন, ‘কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার জন্য বায়োসেফটি লেভেল-৩ মানের ল্যাব লাগে না। বায়োসেফটি লেভেল-২ হলেই হয়। কিন্তু সারাদেশে আমাদের যেসব বায়োসেফটি লেভেল-২ ল্যাব আছে, সেখানে একটি বায়োসেফটি কেবিনেট ব্যবহার করতে হয়। এজন্য প্রতিবছরই সার্টিফিকেশন লাগে। আমাদের দেশে স্থানীয় কোনো সার্টিফায়ার নেই। এজন্য আমাদেরকে ঝামেলায় পড়তে হয়। প্রতি বছর কারও না কারও প্রয়োজন হলে বিদেশ থেকে সার্টিফাই করে আনতে হয়। এজন্য আনুষ্ঠানিকতার ঝামেলাতেও দ্রুত কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।

আইসিডিডিআরবিতে কয়েকজন আছেন, তারা নিজেদের সার্টিফিকেশনের কাজ করার পর আমাদেরটা করে দেয়। এটি যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। কোথাও কোথাও বায়োসেফটি লেভেল থ্রি ল্যাবগুলোকে করোনাভাইরাস প্রোটেকশনের জন্য ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

প্রতিদিন কতজনের নমুনা সংগ্রহ করতে পারছেন জানতে চাইলে ডা. আলমগীর বলেন, ‘প্রায় দেড়শর কাছাকাছি। এ কাজটি আসলে সারাদেশে হাসপাতালগুলোরই করার কথা। যেহেতু এ কাজটি বেশ জটিল ও ঝূঁকিপূর্ণ তাই এ বিষয়ে অনেকেরই প্রশিক্ষণ ছিল না, চর্চা ছিল না। তাছাড়া সব জায়গায় প্রয়োজনীয় লজিস্টিকও নেই। তাই আমরা ঢাকা থেকে গিয়ে গিয়ে করছি। গত সপ্তাহ থেকে চেষ্টা চলছে এ ব্যাপারে ব্যাপ্তি আরও বাড়ানোর। যেহেতু হাসপাতালগুলোর ল্যারেটরি আছে। টেকনোলজিস্টদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তারা যদি স্থানীয়ভাবে রোগীদের স্যাম্পল সংগ্রহ করে আমাদের কাছে পাঠায়, তাহলে আমাদের উপর বোঝা একটু কমবে।’

এ লক্ষ্য নিয়ে নিয়ে আইইডিসিআরকে সারাদেশে কাজ করতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সারাদেশ থেকে হটলাইনগুলোতে যত ফোন আসে, মেইলে যত রোগী নক করেন কিংবা ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে যে বার্তা আসে–আমরা তাদেরকে বলছি, আপনারা বাড়িতেই থাকুন, বাইরে বের হবেন না। এটা কমিউনিটির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের লোকজন আপনাদের বাড়ি গিয়ে স্যাম্পল সংগ্রহ করে নিয়ে আসবে। আমরা এখন পর্যন্ত দৈনিক দেড়শর মতো স্যাম্পল সংগ্রহ করছি। ধীরে ধীরে আমরা হয় তো দৈনিক তিনশর মতো স্যাম্পল সংগ্রহ করতে পারবো।’

একদিনে সর্বোচ্চ কতজনের পরীক্ষা করতে পারছেন জানতে চাইলে আইইডিসিআর’র এ প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘সারা দিনে যতোজনের স্যাম্পল সংগ্রহ হয়, পরের দিন সবগুলোরই পরীক্ষা করা হয়ে যায়। আমাদের মেশিনের সক্ষমতা অনেক। আইইডিসিআরের আটটি মেশিন আছে। কয়েক শিফটে কাজ হচ্ছে। ইচ্ছা করলে প্রতিদিন কয়েক হাজার সেম্পল পরীক্ষা করা সম্ভব।’

সবগুলো মেশিন বায়োসেফটি লেভেল-৩ মানের কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, এগুলো লেভেল-৩ মানের না। তবে বেশ উন্নত মানের। সেফ মেশিনের অনেকগুলো ক্যাটাগরি আছে। আমাদের এখানে লেটেস্ট যেসব মেশিন আছে তার সবগুলোই ওপেন সিস্টেম। অর্থাৎ পৃথিবীর যে কেউ রি-এজেন্ট তৈরি করলে তা আমরা এখানে ব্যবহার করতে পারবো। এতে আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশের সুবিধা হলো যেখানে কম দামে রি-এজেন্ট পাওয়া যাবে সেখান থেকে কিনে নেওয়া যায়।’ অনেক জায়গায় ক্লোজড সিস্টেম মেশিন আছে। এগুলোর সমস্যা হলো, আপনি যদি এক কোম্পানির মেশিন কিনেন তাহলে সারা বছরই ওই কোম্পানির রি-এজেন্ট কিনতে হবে। এ কারণে আমরা ক্লোজড সিস্টেমটাকে অনুমোদন করি না।

পিসিআর’র (PCR) পরিবর্তে কিটের মাধ্যমে রেপিড টেস্ট করে করোনা ডায়াগোনোসিস করা যায় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছর আগেও যখন কারও ডেঙ্গু হতো আমরা তাদের বলতাম, ৫ দিন পরে গিয়ে রক্ত পরীক্ষা করবেন, কারণ রেপিড টেস্টগুলো করা হয় অ্যান্টিবডির সাথে রিএকশনের মাধ্যমে। এন্টিবডি তৈরি শুরু হয় ৪/৫ দিন পর। বিভিন্ন কোম্পানি বাজারে যেসব অ্যান্টিবডি কিট আনতে চায় বা বানাতে চায় সেগুলো এন্টিবডি ডিটেকশনের মাধ্যমে কাজ করে। এ ক্ষেত্রে পজিটিভ ফল পেতে ন্যূনতম পাঁচ দিন অপেক্ষা করতে হবে। তাছাড়া এগুলোতে অনেক ক্ষেত্রেই ‘ফলস নেগেটিভ’ (False negative) রিপোর্ট আসে। মানে রোগী আসলে করোনা আক্রান্ত অথচ রিপোর্টে দেখায় রোগমুক্ত। এখন আমরা যদি একজন লোকের পরীক্ষা করে তাকে বলে দিই, আপনার করোনা ভাইরাস নাই। কিন্তু সে আসলে ‘ফলস নেগেটিভ’ তাহলে সে নিশ্চিন্তে কমিউনিটিতে ঘুরে বেড়াবে আর তার মাধ্যমে করোনা ছড়াতে থাকবে। সেক্ষেত্রে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনটা খুব দ্রুত হয়ে যাবে। সেজন্য আমরা খুব সাবধানে এগুচ্ছি।’

‘আমরা ভাবছি, কিট আদৌ ব্যবহার করবো কিনা? ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যদি আমাদের অনুমতি দেয় তাহলে আমরা হয়তো ব্যবহার করবো। রেপিড টেস্ট হচ্ছে মূলত স্ক্রিনিং টেস্ট। যখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশনটা খুব বেশি পর্যায়ে পৌছে যায়, তখন কিট ব্যবহার করা হয় কমিউনিটিতে অ্যাটাকের ধরনটা কেমন ছিল তা দেখার জন্য করা। সেটা আরও দেড় মাস পরে করলে ভালো হবে’, যোগ করেন আইইডিসিআর’র প্রধান এ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।

স্বল্প সংখ্যক লোকবল নিয়ে আইইডিসিআর এই করোনা মহামারী সামাল দিতে সক্ষম কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের লোকবল কম এ কথা আমরা কোথাও বলছি না। তবে হ্যা আমাদের আরও লোক হলে ভালো হবে। আমরা আমাদের সক্ষমতা অনেক গুণ বাড়িয়েছি। বিভিন্ন বিপর্যয়ে কিন্তু আমরা নিয়মিতই কাজ করে যাচ্ছি।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু বলেন, ‘কাল-পরশু থেকে আমাদের এখানে করোনাভাইরাসে নমুনা পরীক্ষা শুরু হবে। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা নমুনা সংগ্রহের ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারিনি। আমরা যদি ফিল্ডে নমুনা সংগ্রহ করতে যাই, তাহলে এটি আমাদের সাধ্যের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আইইডিসিআর এটা করতে পারে। কারণ তাদের হাসপাতাল নাই, আউট ডোর নাই। বেশি লোকের ভিড় নাই। ঢামেক একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি হাসপাতাল হওয়ায় প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এটি গত বছরের ডেঙ্গুর মতো নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় চলে যাবে।’

আইইডিসিআরের দিনে কয়েক হাজার স্যাম্পল পরীক্ষা করার সক্ষমতাকে যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন সংস্থাটির সাবেক এ প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজে শুরু হলে দিনে কতজনের নমুনা পরীক্ষা করার কথা ভাবছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা আগে করতাম না। মাত্র শুরু করলাম। আমাদের সক্ষমতা আছে দুইশর মতো। তবে প্রাথমিকভাবে হয়তো একশ’র মতো করা সম্ভব হবে।’

তিনি বলেন, রাজধানীতে সরকারি বেসরকারি অনেক হাসপাতালে এ পরীক্ষার সুবিধা চালু করা যাবে। ফলে সেখানেও ধারাবাহিকভাবে করোনা ভাইরাসের রোগীদের স্যাম্পল পরীক্ষা করা সম্ভব হবে। কিন্তু এটা উপজেলা পর্যায়ে সম্ভব না। সেখানে এটা শুরু করতে গেলে পরিণতি ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ছুটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা খালি করে সবাই গ্রামে চলে গেলো। গ্রামে যখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হবে তখন তারা কোথায় পরীক্ষা করবে? আইইডিসিআর কত জায়গায় ছুটবে?

আপনার মতামত দিন :