ম্যাটস ও অন্য ডিপ্লোমাধারীদের উচ্চশিক্ষা! Emon Emon Chowdhury প্রকাশিত: ১২:০৩ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১১, ২০২০ ড. মো. সহিদুজ্জামান : মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া নিয়ে মাঝেমধ্যে আন্দোলন করতে দেখা যায়। দাবিদাওয়ার মধ্যে তাদের উচ্চশিক্ষা ও চাকরির সুযোগ সৃষ্টির কথা বলা হয়। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের সংখ্যা ২০৯। এর মধ্যে সরকারি ম্যাটসের সংখ্যা মাত্র আটটি। পত্রপত্রিকার তথ্যমতে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত এবং এর মধ্যেই লক্ষাধিক শিক্ষার্থী পাস করে বের হয়ে গেছেন। দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) অনুযায়ী জনগণের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার সেবার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৬ সালে সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের (State Medical Faculty) অধীনে তিন বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স চালু করে। পরে এটি চার বছর মেয়াদি একটি ডিপ্লোমা কোর্স হিসেবে চালু হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা ইন অ্যাগ্রিকালচার, ডিপ্লোমা ইন ফরেস্ট্রি, ডিপ্লোমা ইন মেরিন টেকনোলজি, ডিপ্লোমা ইন হেলথ্ টেকনোলজি বিষয়ে চার বছর মেয়াদি শিক্ষাক্রম পরিচালিত হয়। প্রায় ৫০টি সরকারি ও ৩৮৮টি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ১৬টি সরকারি ও ১৬১টি অ্যাগ্রিকালচার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (এটিআই), একটি সরকারি ও ৫৪টি বেসরকারি ফিশারিজ ইনস্টিটিউট, একটি সরকারি ও প্রায় ১৮০টি বেসরকারি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটসহ অন্যান্য ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা ও অধ্যয়নরত লাখ লাখ শিক্ষার্থীর পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ না থাকায় তাঁরা অজানা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। দেড় শতাধিক বছর আগে পলিটেকনিক শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল ডিপ্লোমা শিক্ষা। কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের উচ্চশিক্ষার পথচলা শুরু হয়। পরে বিভিন্ন দ্বন্দ্বে এই সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। দেশে ডিপ্লোমা কোর্সগুলো চালু করা হয় পেশাগত কাজে দক্ষ সহযোগী তৈরি করে সেবার মান গতিশীল করার জন্য। চার বছর ধরে তাঁরা সেসব বিষয়ে পড়াশোনা করেন, একদিকে তা যেমন কখনই এইচএসসির সমমান হিসেবে গণ্য করা সমীচীন নয়, তেমনি তাঁদের উচ্চশিক্ষার দুয়ার বন্ধ রাখা কখনোই কাম্য নয়। এসব ডিপ্লোমা শিক্ষার্থী চার বছরে প্রায় ১৫৫ থেকে ১৬০ ক্রেডিট পড়ে থাকেন, যা ব্যাচেলর ডিগ্রির মোট ক্রেডিটের প্রায় সমান। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বছর মেয়াদি পাস কোর্স করতেও যেমন (১০+২+২=১৪) ১৪ বছর লাগে তেমনি ডিপ্লোমা পাস করতেও ১৪ বছর লাগে। কিন্তু পাস কোর্স ডিপ্লোমা সমমানের নয়, তাই তাঁরা তিন-চার বছর মেয়াদি মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হতে পারেন। আমরা ডিপ্লোমা শিক্ষাকে টেকনিক্যাল বা কারিগরি শিক্ষা হিসেবে ছোট করে দেখি এবং ব্যাচেলর শিক্ষার মতো এই শিক্ষাকে একাডেমিক শিক্ষা বলতে দ্বিধাবোধ করি। অথচ এসব ডিপ্লোমা শিক্ষা অন্যান্য টেকনিক্যাল উচ্চশিক্ষার মতোই প্রায়োগিক শিক্ষা। এমনকি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যে তিনটি স্তর রয়েছে (প্রাথমিক ১-৮, মাধ্যমিক ৯-১২, উচ্চশিক্ষা) তার কোনোটিতে এই ডিপ্লোমা শিক্ষাকে রাখা হয়েছে কি না এর কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায় না। আমাদের ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীরা এভাবেই অবমূল্যায়িত ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। ভারত, পাকিস্তান ও চীনে ডিপ্লোমা গ্র্যাজুয়েটরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়ে থাকেন। চীনে ১২ বছর স্কুলিংয়ের (প্রাইমারি থেকে এইচএসসি) পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতো ডিপ্লোমা বা ভকেশনাল পাস শিক্ষার্থীরাও দুই বছর পোস্ট-সেকেন্ডারি এডুকেশন নিয়ে ব্যাচেলর বা স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির সুযোগ পান। পাকিস্তানে ১২ বছর স্কুলিংয়ের পর তিন বছর ডিপ্লোমা করে পরবর্তী ডিগ্রি হিসেবে ব্যাচেলর অব টেকনোলজি ডিগ্রি করার সুযোগ পাওয়া যায়। ভারতে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে রয়েছে তিন বছর মেয়াদি ব্যাচেলর অব সায়েন্স অথবা চার বছর মেয়াদি ব্যাচেলর অব টেকনোলজি। এ ছাড়া রয়েছে দু-তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্স। ১২ বছর স্কুলিংয়ের পর এসব কোর্সে ভর্তি হতে হয়। ডিপ্লোমা কোর্সে পাসকৃত শিক্ষার্থীরা তিন বছর মেয়াদি ব্যাচেলর অব সায়েন্স অথবা টেকনিক্যাল বিষয়ের ডিপ্লোমাধারীরা ব্যাচেলর অব ইঞ্জিনিয়ারিং বা ব্যাচেলর অব টেকনোলজিতে সরাসরি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সুযোগ পান। অস্ট্রেলিয়াতে ডিপ্লোমা (১২ থেকে ১৮ মাস) শিক্ষার্থীরা ক্রেডিট সমন্বয়ের মাধ্যমে ব্যাচেলর ডিগ্রির প্রথম বর্ষের সমমান হিসেবে দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তির সুযোগ পান। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে একজন শিক্ষার্থী এসএসসি বা দশম গ্রেড অথবা এইচএসসি বা ১২তম গ্রেড পাস করে ডিপ্লোমায় আবেদন করতে পারেন। ১২তম গ্রেড পাস করে এক বছর পড়ালেখা করে টেকনিশিয়ান হওয়া যায় অথবা মাত্র দুই বছর টেকনিক্যাল ট্রেনিং নিয়ে ডিপ্লোমা সার্টিফিকেটও অর্জন করা যায়। আরো এক বছর পড়াশোনা করলে উচ্চতর ডিপ্লোমা ডিগ্রি, তারপর এক বছর পড়াশোনায় বিএসসি ডিগ্রি ও আরো এক বছর পড়াশোনায় এমএসসি ডিগ্রি অজর্েনর সুযোগ থাকে। তাই ডিপ্লোমা শিক্ষা উচ্চশিক্ষার ধারাবাহিক শিক্ষাব্যবস্থা (ডিপ্লোমা টু ডিগ্রি)। একজন ম্যাটস্ শিক্ষার্থী চার বছর ধরে এমবিবিএস কোর্সের প্রায় সব বিষয় যেমন মাইক্রোবায়োলজি, প্যাথলজি, ফিজিওলজি, অ্যানাটমি, মেডিসিনসহ বিভিন্ন প্যারাক্লিনিক্যাল ও ক্লিনিক্যাল বিষয়গুলো পড়ে থাকেন। এমবিবিএস পড়ার জন্য এসব পূর্বশর্ত (prerequisite) বিষয়গুলো যেহেতু তাঁরা পড়ে থাকেন, তাঁদের অবশ্যই এই পেশার ওপর উচ্চশিক্ষা গ্রহণে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে তাঁদের ভর্তির ক্ষেত্রেও সুযোগ দেওয়া উচিত। ঠিক একইভাবে কৃষি, মত্স্য, ফুড ও অন্য ডিপ্লোমাধারীদের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ থাকা উচিত। যেমনটি বর্তমানে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, আর্কিটেকচার, অ্যাগ্রিকালচার কোর্সের শিক্ষার্থীদের ডুয়েট (ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর) সুযোগ দিয়ে থাকে। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, রংপুর ম্যাটস্ শিক্ষার্থীদের মাইক্রোবায়োলজিতে স্নাতক ডিগ্রি প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে কিছু কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ডিপ্লোমাধারীদের ভর্তির সুযোগ দিচ্ছে। বাংলাদেশে বহির্বিশ্বের মতোই ক্রেডিট সিস্টেম চালু হলেও State Medical Faculty-র আওতায় পাস করা এই ম্যাটস্ শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় সেই পুরনো ধারার সার্টিফিকেট, যেখানে নম্বরপত্রে শুধু পাস উল্লেখ থাকে। প্রাপ্ত মোট নম্বর বা হার (পার্সেন্ট) উল্লেখ না থাকায় ও প্রাপ্ত ফলাফলকে জিপিএতে রূপান্তরের কোনো সুযোগ না থাকায় পাসকৃত এসব শিক্ষার্থীকে দেশে ও বিদেশে আবেদনের ক্ষেত্রে বিপদে পড়তে হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক ডিপ্লোমা কোর্সে চার স্কেল গ্রেডিং সিস্টেম চালু থাকায় এসএসসি ও এইচএসসির ৫ স্কেলের সঙ্গে বৈষম্য সৃষ্টি হওয়ায় তাঁদের উচ্চশিক্ষায় ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। সাধারণত অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী ও গরিব শিক্ষার্থীদের এসব ডিপ্লোমা কোর্সে পড়াশোনা করতে দেখা যায়। এ ছাড়া সরকারি ডিপ্লোমা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনার মান মোটামুটি থাকলেও বেসরকারিগুলোর অবস্থা অনেকটাই নাজুক। চাকরিরত অবস্থায় পার্টটাইম পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষার আগ্রহ অনেকেরই অথবা সহজেই ডিগ্রি নেওয়া যায় এমন চিন্তাভাবনাই বেশি থাকে এসব শিক্ষার্থীর। ফলে দেশে যেখানে প্রকৌশল, কৃষি ও চিকিৎসাবিদ্যায় পড়তে অনেক মেধাবী সুযোগ পান না সেখানে ডিপ্লোমা শিক্ষাকে এ শিক্ষার্থীরা যাতে বিকল্প পথ হিসেবে ব্যবহার করতে না পারেন সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর ভর্তির যোগ্যতায় শর্ত আরোপ করা যেতে পারে ও নির্দিষ্টসংখ্যক ডিপ্লোমাধারীকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এসএসসি বা সমমান পাস করে ভর্তির ক্ষেত্রে জিপিএ ও ডিপ্লোমায় প্রাপ্ত জিপিএ বা ফলাফল অবশ্যই সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। ডিপ্লোমা শিক্ষার প্রয়োগিক ব্যবহার ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে পেশাগত কাজে ব্যবহারের লক্ষ্য সমুন্নত রেখে ডিপ্লোমা শিক্ষাকে আরো আধুনিকায়ন করা দরকার। তাহলে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে এসব ডিপ্লোমাধারী নিজেদের জায়গা করে নিতে পারবে। লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, প্যারাসাইটোলজি বিভাগ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ আপনার মতামত দিন : SHARES ডিপ্লোমা সংবাদ বিষয়: