করোনা ভাইরাসের কারণে মৃত মানুষের দেহ সংক্রামক কিনা, এবং এমন মৃতদেহের ক্ষেত্রে করনীয় Shahadat Shahadat Hossain প্রকাশিত: ১১:১৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১২, ২০২০ ডাঃ ফজলে এলাহী খাঁন : পত্রপত্রিকার খবরে রেগুলার দেখতে পাচ্ছি করোনাভাইরাসে মৃত্যু সন্দেহে অনেক মৃতদেহ সৎকারের ব্যাপারে অনেকের মধ্যে ভীতি কাজ করছে। অনেকে মৃতদেহকে অমানবিকভাবে ফেলে পালিয়ে যাচ্ছেন, কেউবা নিজ এলাকায় দাফনের বিষয়ে তুলছেন আপত্তি। এই প্রতিক্রিয়াগুলো অমানবিক তো বটেই, অজ্ঞানতাপ্রসূতও। মৃতদেহ থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায় কিনা তা বুঝতে হলে প্রথমে জানতে হবে, করোনাভাইরাস কিভাবে ছড়ায়। একেক সংক্রামক রোগ একেকভাবে ছড়ায়। কিছু ছড়ায় খাবার থেকে, কিছু যৌন সংসর্গের মাধ্যমে, কিছু বায়ুবাহিত, আবার কিছু ড্রপলেট বা মুখনিসৃত লালা কণিকায় ভর করে। হাম এবং জলবসন্তের ভাইরাস যেমন, বাতাসে ভর করে ছড়ায় এবং বাতাসেই তা অনেকক্ষণ অবস্থান করে। অনেকের ভুল ধারণা আছে যে, করোনভাইরাস যেহেতু শ্বাসতন্ত্রকে আক্রমণ করে, এটাও হয়তো নিশ্বাসের মাধ্যমে বাতাসে ছড়ায় ও ভেসে বেড়ায়। প্রকৃত সত্য হলো, করোনাভাইরাস হাঁচি-কাশির সাথে অথবা শ্বাসতন্ত্রের নিঃসরণের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয় ঠিকই, কিন্তু ভাইরাসটির গঠনগত কারণে তা বাতাসে বেশিক্ষণ ভেসে থাকতে পারেনা। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, এই ভাইরাস লালাকণিকা বা ড্রপলেটে ভর করে সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত যেতে পারে; এর পর তা আশপাশের পৃষ্ঠতলে নেমে আসে। সেখানে এই ভাইরাস কয়েক ঘন্টা থেকে সর্বোচ্চ নয় দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। উপরের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার হলো যে, ভাইরাসটিকে মানুষের শরীর থেকে বের হতে হলে হাঁচি-কাশি অথবা শ্বাসতন্ত্রের নিঃসরণের মাধ্যমেই বের হতে হবে। এবার পাঠকের কাছে আমার প্রশ্ন, মৃতব্যক্তি কি হাঁচি-কাশি কিম্বা থুথু নিক্ষেপ করতে পারে? পারেনা। তবে তার শরীরে বা কাপড়ে লালা কণিকা লেগে থাকতে পারে। সেটিও মৃতদেহ গোসল দেওয়া হলে দুর হয়ে যায়। গোসলের স্থান ব্লিচিং সলিউশন (প্রতি লিটারে এক চামচ ব্লিচিং পাউডার) দিয়ে ধুয়ে ফেললে, গোসলের স্থানটিও জীবাণুমুক্ত হয়ে যায়। কবরের নিচ থেকে এই ভাইরাসে বের হয়ে আসার কোনই সম্ভাবনা নেই; কাজেই, কোন কবরস্থানে করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিকে কবরস্থ করা হলে সেখান থেকে আশপাশের মানুষের সংক্রমিত হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। এমনকি গোসলের স্থানটি ভুলক্রমে ব্লিচিং সলিউশন দিয়ে পরিষ্কার করা না হলেও (যদিও এটি সমর্থনযোগ্য না) ভাইরাস সর্বোচ্চ নয় দিনের মধ্যে নিজে নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে। এটা সত্য যে, কিছু কিছু রোগের কারণে মৃতদেহও সংক্রামক থেকে যায়। আমরা আশ্বস্ত হতে পারি যে করোনাভাইরাসজনিত রোগ তেমন নয়। রক্তক্ষরণ ঘটানো ইবোলা রোগ, কলেরা ইত্যাদি রোগে মৃতদেহ মৃত্যুর পরও সংক্রামক থাকে। সংক্রামক ইনফ্লুয়েন্জায় মৃত দেহও ময়নাতদন্তের সময় সংক্রমণ ছড়াতে পারে। এরকম দুই একটা ব্যতিক্রমী রোগ ছাড়া আর কোন রোগের মৃতদেহই সংক্রামক নয়। এমন একটা ভ্রান্ত ধারণাও প্রচলিত আছে যে, যে কোন সংক্রামক রোগে মৃত্যু হলেই সেই মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলতে হয়। এগুলো সম্পূর্ণ অমূলক। করোনাভাইরাসে মৃত্যু হলে তা মৃত্যুর পর সংক্রামক নয়, কাজেই কিছু সাবধানতা অবলম্বন করে সম্পূর্ণ নিরাপদে তা দাফন করা যায়। দাফনের পরও এ থেকে কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই। তবে যারা মৃতদেহ স্পর্শ করবেন, তাদের কিছু সাবধানতার প্রয়োজন আছে। তারা মৃতদেহ খালিহাতে ধরবেন না। সার্জিকাল মাস্ক, গ্লাভস, গাউন, পানির ছিটা পরার সম্ভাবনা থাকলে ফেসশীল্ড বা গগলস—এসব ব্যবহার করবেন। ষাটোর্ধ ব্যক্তি বা এমন ব্যক্তি যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম আছে (যেমন যাদের শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস বা ইমিউন সিস্টেমের কোন রোগ আছে) তারা কোনক্রমেই মৃতদেহ গোসল দেওয়া অথবা অন্যকোন সৎকার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবেন না। মৃতদেহ পরিবহণের জন্য সাধারণভাবে যে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়, তা-ই করবেন; করোনাভাইরাসের কথা মাথায় রেখে আলাদাভাবে করার কিছু নেই। আত্মীয়স্বজন নির্দ্বিধায় মৃতদেহকে শেষবারের মতো দেখতে পারবেন, তবে স্পর্শ বা চুম্বন করা যাবেনা। সাবধানতার স্বার্থে মৃতদেহ দেখার পর সাবান পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুলে ফেলবেন। অবশ্য যারা শ্বাসতন্ত্রের কোন রোগে ভুগছেন তাদের মৃতদেহ দেখতে না যাওয়াই ভালো; আর দেখলেও সার্জিকাল মাস্ক পরেই সেখানে যাবেন। যারা মৃতদেহ কবরস্থ করবেন, তারা গ্লাভস পরবেন এবং কাজ শেষে গ্লাভস খুলে সাবান পনি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলবেন। তাদের গাউন বা অন্য কোন বিশেষ পোশাক পরার দরকার নেই। মৃত ব্যক্তির ব্যবহৃত দ্রব্যাদি পুড়িয়ে ফেলার বা অন্য কোন ভাবে ধ্বংস করার প্রয়োজন নেই। সেগুলো গ্লাভস পরে ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে পরে ব্লিচিং সলিউশন দিয়ে পুণর্বার জীবাণুমুক্ত করতে হবে। পোষাক ও অন্যান্য কাপড়চোপড় একটি ড্রামে ৬০ থেকে ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিতে চুবিয়ে লাঠি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে যেন হাতে পানি না লাগে। এরপর পানি ফেলে দিয়ে ০.০৫% ক্লোরিন সলিউশন দিয়ে অন্ততঃ ৩০ মিনিটের জন্য আবার ভেজাতে হবে। পরিশেষে, সেই কাপড় পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে রোদে শুকাতে হবে। কাজেই, আমরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যে মানুষটি মারা গিয়েছেন, তার মৃতদেহের প্রতি কোনরকম অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা অথবা অবহেলা দেখাবোনা; ভয় পাবোনা। নিকটাত্মীয়রা এমনকি তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র উপযুক্ত পদ্ধতিতে জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহারও করতে পারবেন। মৃতদেহের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা দেখাতে অথবা মৃতদেহকে দেখতেও কোন বাধা নেই। তবে মনে রাখতে হবে, মৃতদেহ দেখার সময় ভীড় করা যাবেনা; একজনের সাথে আরেকজনের ৩ থেকে ৬ ফুট দুরত্ব বজায় রাখতে হবে। কারণ, মৃতদেহ সংক্রমণ না ছড়ালেও আক্রান্ত কোন জীবিত ব্যক্তি আপনার খুব কাছে থাকলে, তার কাছ থেকেই বরং সংক্রমণ ছড়াতে পারে। সুত্রঃঃ- ড. তৌফিক জোয়ার্দার, এমবিবিএস, এমপিএইচ, ডিআরপিএইচ (জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়), জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ নির্বাহী পরিচালক: পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ (Public Health Foundation of Bangladesh) আপনার মতামত দিন : SHARES স্বাস্থ্য বিষয়: