বেসরকারি মেডিকেলের ৮২ ভাগের বোনাস ও ৬১ ভাগের বেতন হয়নি

Emon Emon

Chowdhury

প্রকাশিত: ৪:০৪ পূর্বাহ্ণ, মে ২৩, ২০২০

করোনাভাইরাস মহামারীতে দেশ যখন বিপর্যস্ত। তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা। এসব যোদ্ধাদের মনোবল ধরে রাখতে এরই মধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রণোদনাসহ দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু সুবিধা প্রদানের ঘোষণা।

কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের এ দুঃসময়ে ঠিক উল্টো এক অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে হচ্ছে বেসরকারি খাতের চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের। প্রণোদনা দূরে থাক স্বাভাবিক বেতন এবং সারাবছরের শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত প্রাপ্য বোনাস নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন তারা। এমনকি অধিকারের কথা বলতে গিয়ে চাকরি হারানোর হুমকির মুখেও পড়েছেন কেউ কেউ।

পেশাজীবীদের সংগঠনের নেতাদের দাবি, তাদের কাছে থাকা পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৮২ ভাগ প্রতিষ্ঠানে বোনাস ও ৬১ ভাগের বেতন এখনো হয়নি।

তবে বেসরকারি মেডিকেল মালিকদের সংগঠন বিপিএমসিএ জানিয়েছে, সারাদেশে এরই মধ্যে ৯০ ভাগ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বেতন দিয়ে দিয়েছে।

ভুক্তভোগীদের বক্তব্য 

বেতন ও ঈদ বোনাস পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন কুমিল্লার সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে কোনো সমাধান হচ্ছে না জানিয়ে তারা বলেন, উল্টো চাকরি হারানোর ভয় দেখানো হচ্ছে তাদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেন্ট্রাল মেডিকেলের একজন চিকিৎসক  জানিয়েছেন, মার্চ মাসের ১৬ তারিখ কলেজ বন্ধ হয়েছে। মার্চের বেতন হয়েছে। এর পর কোনো রকম পূর্বঘোষণা ছাড়াই এক নোটিসে জানানো হয়, এপ্রিল মাসের বেতন ৭০ ভাগ দেওয়া হবে। আর কোনো উৎসব ভাতা দেওয়া হবে না। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কলেজ ফান্ডে টাকা নাই। তাই পুরো বেতন ও বোনাস দেওয়া যাবে না।

এর পরিপ্রেক্ষিতে সুবিধাজনক সময়ে বোনাস ও বেতনের বাকি অংশ পরে পরিশোধের দাবি জানান তারা। কিন্তু এতেও সম্মতি দেয়নি কর্তৃপক্ষ। এমনি করোনা সংকট অব্যাহত থাকলে লেকচারারদের চাকরিচ্যুতিরও হুমকি দেন তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুমিল্লা ময়নামতি মেডিকেল কলেজের একজন চিকিৎসক  বলেন, যারা অ্যাকামেডিক সেকশনে আছেন তাদের কাউকে ৭০ ভাগ এবং কাউকে ৫০ ভাগ বেতন দেওয়া হয়েছে। আর হাসপাতাল সেকশনের কাউকে ৮০ ভাগ বেতন দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের পুরো বেতন দেওয়া হয়েছে। তবে কাউকেই বোনাস দেওয়া হয়নি।’

কেন এমনটি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে মূল দোষটা হলো, বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমসিএ)। তারাই প্রথম পুরো বেতন না দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। এখান থেকে সবাই এ ব্যাপারে একটি ধারণা পায়। এর আগে এ নিয়ে কারও মাথায় এ ধরনের কোনো চিন্তা ছিল না।’

এছাড়া ময়নামতির হাসপাতাল সেকশনের প্রায় সবাইকে নন-পেএবল ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বিলেন, এ ক্ষেত্রে শুধু নয়জন ডাক্তারকে রাখা হয়েছে, যাতে হাসপাতাল খোলা রাখা যায়।

চিকিৎসকরা বলেন, ‘এখানকার চিকিৎসকরা না পারছে কোথাও হাত পাততে, না পারছে রোজগারের জন্য কোথাও যেতে। এ দুঃসময়ে ক্লিনিকগুলোও বেতন দিচ্ছে। হয় তো আগে ৫ তারিখে দিতো, এখন ১০ তারিখে দিচ্ছে। কিন্তু একটি মেডিকেল কলেজের এ অবস্থা আসলেই অপ্রত্যাশিত।’

বিপিএমসিএ’র বক্তব্য 

এ প্রসঙ্গে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমসিএ) সভাপতি এম এ মুবিন খান বলেন, ‘ঢাকা শহরে ১৫টার মতো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আছে। ফোন করে দেখেন বেতন-বোনাস দিতে কত ভাগ বাকি আছে। দুই-একটা ভিন্ন ঘটনা আছে, কিন্তু সবাই দিয়েছে। সারাদেশে এরই মধ্যে ৯০ ভাগ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বেতন দিয়ে দিয়েছে। জন্ম নেওয়ার পরে সব শিশু সুস্থ হয় না, কিছু অসুস্থও থাকে। ৫-৬টা থাকতেই পারে। এ দুঃসময়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে আঘাত করার একটা প্রবণতা শুরু হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘যেসব স্বাস্থ্যকর্মী বেতন পান না তারা গণমাধ্যমের দ্বারস্থ হন, এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তারা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চেয়ারম্যান, বোর্ডের কাছে যেতে পারতো। আর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য ডিজি অফিস কিংবা মন্ত্রণালয় আছে। তাদের কাছে সুখ-দুঃখ বলতে পারে। সেখানে গেলেই তো তাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। মালিকদের একটি অ্যাসোসিয়েশন আছে, সেখানে এখনও পর্যন্ত কোনো অভিযোগ আসেনি। তারা সেখানে না গিয়ে গণমাধ্যমে বলার কারণ কি? এমন যদি হতো ৬০ ভাগ প্রতিষ্ঠান বেতন দেয়নি, তাহলে এটা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয় হতো। ৯০ ভাগ প্রতিষ্ঠান বেতন দিয়েছে। বাকিদের সমস্যা সমাধানের পথে।’

তিনি বলেন, ‘সারাপৃথিবী এখন একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি। পৃথিবীর মানুষ বিগত একশ’ বছরে এ রকম সমস্যা দেখেনি। সারাপৃথিবী লকডাউন। এ সময়ে এ জাতীয় প্রশ্ন তুলে…। দু-চারটা প্রতিষ্ঠানে (বেতন না দেওয়া) হতেই পারে। সবার অর্থনেতিক সক্ষমতা তো সমান না। সবার আয়ের উৎসও সমান না। এটা হতেই পারে, এটা স্বাভাবিক। কেউ যদি দুই মাস, তিন মাস দিতে না পারে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দিয়ে দেবে। সারাজীবন তো এই অবস্থা চলবে না। এর পরও কেউ যদি অস্বাভাবিকভাবে বেতন না দেয়, কারও প্রতি যদি অবিচার করে, অন্যায় করে। সেজন্য দেশে একটি শক্তিশালী সরকার আছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট শাখায় অভিযোগ করতে হবে।’

পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা যা বললেন

বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের (বিডিএফ) প্রধান সমন্বয়ক ডা. নিরুপম দাশ বলেন, ‘আমাদের কাছে থাকা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৮২ ভাগের বোনাস হয়নি। ৬১ ভাগের বেতন হয়নি। আমরা বিষয়টি নিয়ে নিয়মিত কথা বলে আসছি। তাদের যুক্তি হলো, করোনার সময় তাদের আয় কম। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জানুয়ারিতে তারা শিক্ষার্থী ভর্তি করালো। সুতরাং তাদের কাছে টাকা নাই—এটা বিশ্বাস করা যায় না। তারা যে এত বছর লাভ করেছে এই লভ্যাংশ চিকিৎসকদের দিয়েছে?’

তিনি বলেন, ‘বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু কার্যত কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান না। আমাদের চাপে কিছু কিছু জায়গায় বেতন ও বোনাস দিয়েছে। কিন্তু কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বলেছে তারা দিতে পারবে না। এ অবস্থা চলমান থাকলে আমরা আইনি পদক্ষেপ নেবো।’

চিকিৎসকদের সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি অ্যান্ড রাইটসের (এফডিএসআর) মহাসচিব ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) গত ২ মে ঘোষণা দেয় এপ্রিলে ৬০ ভাগ বেতন দেবে, বোনাস দেবে না। তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিবাদ করে এফডিএসআর। পরে ৪ মে আরেকটি মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয় বিপিএমসিএ। এর পর বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। কোনো কোনো মেডিকেল কলেজে ৭০ ভাগ, কোথাও ৬০ ভাগ এবং কোথাও ৫০ ভাগ বেতন দেওয়া হচ্ছে এবং অনেক জায়গাতেই বোনাস হয়নি।

এফডিএসআর’র রিট পিটিশন 

বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেল কলেজে বেতন কর্তন এবং বোনাস প্রদান না করার পরিপ্রেক্ষিতে রিট পিটিশন দায়ের করেছে চিকিৎসকদের সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি অ্যান্ড রাইটস (এফডিএসআর)। মঙ্গলবার (১৯ মে) সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ইয়াদিয়া জামানের সহায়তায় রিট পিটিশন করা হয়।

এফডিএসআর মহাসচিব বলেন, ‘আমরা প্রথমে বলেছিলাম, বেতন-বোনাসের ব্যত্যয় ঘটলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ কথার সূত্র ধরেই গতকাল রিটটি দায়ের করা হয়েছে।’

জরুরি ভিত্তিতে বেতন-বোনাস দেওয়ার দাবি অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহর

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘দেওয়া উচিত। এটি ঝুলিয়ে রাখলো কেন? ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের এটুকু সম্মান না দিলে তারা কিভাবে চলবে? যত কষ্টই হোক জরুরি ভিত্তিতে তাদের বেতন-বোনাস দেওয়া উচিত। বেতন-বোনাস ঝুলিয়ে রাখলে তারা কাজ করবে কিভাবে? এর পর কাজ করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়ে গেলে আবার তাঁদের বসিয়ে রাখতে হবে। তখন রোগীরা তো স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের সব ধরনের সুরক্ষা আগে নিশ্চিত করতে হবে। এটি নিশ্চিত হলে তারা কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে, ভয় পাবে না।

তিনি আরও বলেন, ‘এই সময়ে রোগী দেখে ঘরে যেতে ভয় পাচ্ছে ডাক্তাররা। ঘরে ছেলে-মেয়ে, পিতা-মাতা আছে। এজন্য তাদের আলাদা বাসস্থান ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।’

আপনার মতামত দিন :