প্লাজমা থেরাপি কি? করোনায় আক্রান্ত হলে কখন দিবেন প্লাজমা থেরাপি – ডাঃ ফজলে এলাহী খাঁন

Shahadat Shahadat

Hossain

প্রকাশিত: ৩:৩১ অপরাহ্ণ, জুন ২৮, ২০২০

প্লাজমা থেরাপী কি এবং

কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এটি কীভাবে কাজ করে এবং যেভাবে এই মহামারি থেকে অন্যদের বাঁচাতে পারে

 

পৃথিবী জুড়ে এক অদৃশ্য ভাইরাসের প্রকোপে বিপন্ন হয়ে পড়ে গোটা বিশ্ব। প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। সেই সাথে মৃত্যুর মিছিল ও ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে।কোভিড-১৯ বা নোবেল করোনা ভাইরাস এর প্রকোপ রুখতে এখনো আবিষ্কৃত হয়নি কোন প্রতিষেধক কিংবা টিকা।তবে শত বছরের পুরনো প্লাজমা থেরাপির দিকেই ঝুকছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। তবে কিছুটা আশার আলো ও দেখাচ্ছে এই প্লাজমা থেরাপি। এই প্লাজমা থেরাপি নিয়ে আজকের আলোচনা।

 

প্লাজমা কি?

——————

প্লাজমা হলো রক্তের জলীয় উপাদান। বাংলায় বলা হয় ‘রক্তরস’।রক্তের মধ্যে প্রায় ৫৫ ভাগই থাকে হলুদাভ রঙের এই প্লাজমা। এতে থাকে নানা দরকারি প্রোটিন, রক্ত জমাট বাঁধার প্রয়োজনীয় ফ্যাক্টর আর থাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন, যাকে আমরা অ্যান্টিবডি বলি।

 

প্লাজমা থেরাপী কি?

——————————

কোভিড-১৯ আক্রান্ত যেসব মানুষ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন,বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা মনে করছেন, এদের রক্তে আছে এমন এক উপাদান, যা করোনা

ভাইরাস মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।বিজ্ঞানীরা এই রক্তরস

(প্লাজমা) ব্যবহার করে করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় যে কৌশল অবলম্বনের কথা চিন্তা করছেন তাকে বলে ‘কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি।’

 

বিশ্বের অনেক দেশে ইতোমধ্যেই করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি শুরু করা হয়েছে। বাংলাদেশেও ইতিমধ্যে  সরকারী/বেসরকারি হাসপাতালে কনভালসেন্ট প্লাজমা থেরাপির পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু হয়েছে। সফলতা পাওয়া গেলে করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসায় এটি পুরোদমে শুরু করা হবে।চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি বেশ পুরোনো একটি পদ্ধতি,এই পদ্ধতিতে সাধারণত কোন ভাইরাল সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা মানুষের রক্ত সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেই রক্ত সঞ্চালিত করা হয় একই ধরনের ভাইরাল সংক্রমণের শিকার রোগীর দেহে।১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুর মহামারি এবং ১৯৩০ এর দশকে হামের চিকিৎসায় এই পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়েছিল। একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে ইবোলা, সার্স,মার্স এবং সোয়াইন ফ্লু( H1N1) এর মতো রোগের চিকিৎসায়ও এটি ব্যবহার করা হয়েছে।

 

কারা প্লাজমা দিতে পারবেন?

—————————————–

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন এমন যেকোনো ব্যক্তিই হতে পারেন সম্ভাব্য প্লাজমাদাতা। আগে কোভিড-১৯ পজিটিভ ছিলেন আর এখন পরপর দুবার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ প্রমাণিত হয়েছেন এবং নেগেটিভ হওয়ার পর কমপক্ষে ১৪ দিন (কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২৮ দিন) কোনো উপসর্গ দেখা দেয়নি এমন ব্যক্তিই হতে পারেন প্লাজমাদাতা। প্লাজমা দানের আগে নিশ্চিত হতে হবে যে তাঁর শরীরে যথেষ্ট মাত্রায় অ্যান্টিবডি উৎপাদিত হয়েছে কি না। এ জন্য অ্যান্টিবডি টাইটার পরীক্ষা করা হয়। আমাদের দেশের নীতিমালা অনুযায়ী ১: ১৬০ টাইটার হলে প্লাজমা থেরাপির জন্য উপযুক্ত বলে ধরা হয়। রক্ত পরিসঞ্চালনের অন্যান্য শর্ত যেমন রক্তবাহিত রোগের (সিফিলিস, ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস, এইচআইভি ইত্যাদি) উপস্থিতি, প্লাজমাদাতার ওজন, রক্তচাপ, গর্ভাবস্থা—এই বিষয়গুলো তো দেখতেই হবে।

 

একজন ব্যক্তি কতজনকে এবং কয়বার প্লাজমা ডোনেট করতে পারবেন?

——————————————————————–

একজন দাতার শরীর থেকে একবারে ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিলিটার প্লাজমা নেওয়া সম্ভব,অ্যাফেরেসিস যন্ত্রের মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় দাতার শরীর থেকে পুরো রক্ত না নিয়ে শুধু প্লাজমা নেওয়া সম্ভব। একজন দাতার প্লাজমা দিয়ে তিন ইউনিট পর্যন্ত (প্রতি ইউনিট ২০০ মিলিলিটার)প্লাজমা বানানো যায়। দাতা চাইলে একবার প্লাজমা দেওয়ার পরের সপ্তাহে আবারও প্লাজমা দিতে পারবেন।প্লাজমা দান করার পর ২৪ ঘণ্টায় তিন লিটার পানি পান করলেই এর অভাব পূরণ হয়ে যায়।

 

কারা প্লাজমা নিতে পারবেন?

—————————————–

কোভিড-১৯ আক্রান্ত প্রমাণিত হয়েছেন,অন্তত যাদের মাঝারি ও মারাত্বক ধরনের উপসর্গ আছে (যেমন   শ্বাসকষ্ট, অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯০% এর নিচে নেমে যাওয়া,নিউমোনিয়া বা ফুসফুসে পানি জমে যাবার মতো অবস্থা অথবা মৃত্যু পথযাত্রী রোগী, যাদের শ্বাসতন্ত্র বিকল হয়ে গেছে , সেপটিক শক বা মাল্টি অর্গান ফেইলিউর হওয়ার আশঙ্কা আছে  কেবলমাত্র তাঁরাই প্লাজমা থেরাপী নিতে পারবেন। যাঁদের আগে প্লাজমা বা অন্যান্য রক্ত উপাদান গ্রহণে অ্যালার্জির ইতিহাস আছে, তাঁরা প্লাজমা নিতে পারবেন না।

 

ঝুঁকি আছে কি না?

—————————

প্লাজমা থেরাপিতে তেমন কোনো ঝুঁকি এখনো পাওয়া যায়নি। তবে রক্ত বা রক্ত উপাদান পরিসঞ্চালনের যেসব ঝুঁকি আছে, তা এখানেও প্রযোজ্য। যেমন অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া, রক্তবাহিত জীবাণু সংক্রমণ, পরিসঞ্চালনজনিত ফুসফুসের সমস্যা ইত্যাদি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন কী

————————————————

শুধু পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর্যায়ে এটিকে রাখার পরামর্শ দিচ্ছে সংস্থাটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি অন্তর্বর্তীকালীন গাইডলাইন দিয়েছে। যাতে প্লাজমা থেরাপিকে ‘ইনভেষ্টিগেশনাল থেরাপিউটিকস’ বলা হয়েছে।তাদের বক্তব্য, কোভিড ১৯-এর চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি সকল রোগীর উপর সন্দেহাতীত

ভাবে কাজ করে এমন কোন প্রমাণ নেই।

সংস্থাটি বলছে, পরীক্ষামূলক প্রয়োগের বাইরে গবেষণার অংশ হিসেবে এটির প্রয়োগে অংশ নিতে চাইলে এর লাভক্ষতি যাচাই করার পর একটি যোগ্যতাসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কমিটি এবং নৈতিকতা বিষয়ক কমিটির কাছে থেকে অনুমোদিত হতে হবে।প্লাজমা থেরাপি ব্যাবহারের আগে রোগীর কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। প্লাজমা থেরাপি ব্যবহারের পর তার ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে, তা সঠিকভাবে নথিভুক্ত করে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অবহিত করতে হবে।

সোসালমিডিয়ায় প্লাজমা থেরাপিঃ-

————————————————

ফেসবুকে ‘প্লাজমা’ শব্দটি লিখে খুঁজে অন্তত কুড়িটি গ্রুপ পাওয়া গেছে। প্রায় সবগুলোতে লেখা রয়েছে এই গ্রুপগুলোর মূল উদ্দেশ্য মানুষকে সাহায্য করা।

এমন কয়েকটি গ্রুপে দেখা গেলো প্রতি ঘণ্টায় বহু মানুষ প্লাজমা দানকারীর খোঁজে ফোন নম্বর আর হাসপাতালের নামসহ পোষ্ট দেয়া হচ্ছে। প্রতিদিন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা যত বাড়ছে এ সম্পর্কিত পোষ্ট আরও বেশি চোখে পড়ছে।

 

এদিকে বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে  একটি প্লাজমা ব্যাংক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ তবে রোগীদের সুস্থ করে তুলতে বাংলাদেশে প্লাজমা থেরাপি কতটা সফল হচ্ছে সে সম্পর্কে কোন তথ্য এখনো নেই।তাই এ ব্যাপারে গবেষণালদ্ব গাইডলাইন প্রনয়ণ জরুরি।

 

লেখক

ডাঃ ফজলে এলাহী খাঁন (এনাম)

সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান

আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ,নোয়াখালী।

সাংগঠনিক সম্পাদক,বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশন।

ভাইস চেয়ারম্যান,বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন(বিডিএফ)

সভাপতি, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)নোয়াখালী জেলা শাখা।

 

তথ্যসূত্রঃসোসালমিডিয়া,প্রথমআলো,বিবিসি বাংলা ও Mayo clinic,USA।

 

আপনার মতামত দিন :