মেডিকেল টেকনোলজিস্ট সঙ্কটে ব্যাহত নমুনা সংগ্রহ

Emon Emon

Chowdhury

প্রকাশিত: ৮:১৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৪, ২০২০

চতুর্থ ধাপে থাকা করোনা এখন কমিউনিটি সংক্রমণ হচ্ছে। আক্রান্তের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়ে চলায় এ ভাইরাস শনাক্তে নমুনা সংগ্রহে বেগ পেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীদের। কেননা করোনার নমুনা সংগ্রহের জন্য দেশের প্রতি উপজেলায় মাত্র একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োজিত আছেন। তাদের রোজ ১০ থেকে ২০টি স্যাম্পল কালেকশনের জন্য বলেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অনেক সময় সন্দেহজনক করোনা রোগীর বাড়ি বাড়ি গিয়েও নমুনা সংগ্রহ করছেন তারা।

আর সারা দেশে মাত্র চার-পাঁচশ টেকনোলজিস্ট করোনা সন্দেহ রোগীদের নমুনা সংগ্রহের কাজ করছেন। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তাদের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। পরিস্থিতি যখন খারাপের দিকে যাচ্ছে, তখন প্রশ্ন উঠেছে এত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দেশে কীভাবে মাত্র চার-পাঁচশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নমুনা সংগ্রহের কর্মযজ্ঞ সামাল দেবেন?  করোনা সন্দেহ রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট ল্যাবে পরীক্ষা করে ফলাফলের আগ পর্যন্ত পুরো কাজটি করে থাকেন মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা। প্রথমত বিদেশ ভ্রমণে অভিজ্ঞতা, বিদেশ ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ও করোনার লক্ষণ দেখা গেলে করোনা টেস্ট করা হলেও এখন সাধারণ কিছু উপসর্গ পেলেই করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ পরীক্ষার নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হলো পলিমার চেঞ্জ বা পিসিআর। বিশেষ ধরনের নিরাপত্তাসম্পন্ন ল্যাবে এটি পরীক্ষা করা হয়। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ছাড়াও ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক), ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), রাজশাহী ও ময়মনসিংহ মেডিকেলসহ বেশ কিছু জায়গায় করোনার নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হচ্ছে। আর ঢাকায় ৯টি ও ঢাকার বাইরে ৫টি ল্যাবে করোনা পরীক্ষা চলছে।

বুধবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলছেন, দেশে চলমান করোনার প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে করোনা টেস্টিং আরও বৃদ্ধি করার বিকল্প নেই। কিন্তু এত অপর্যাপ্ত লোকবল নিয়ে কীভাবে টেস্টিং বৃদ্ধি করা সম্ভব?

চিকিৎসাবিদরা বলছেন, সহসাই মেডিকেল টেকনোলজিস্ট না বাড়ালে ভয়াবহ বিপদ হবে। কারণ টেস্ট না বাড়াতে পারলে করোনার রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হবে না। তারা বলছেন, করোনা পরীক্ষাটি খুবই সংবেদনশীল। সংগ্রহ থেকে শুরু করে যথাযথ পরীক্ষা হলো কি না, সতর্ক থাকতে হয়। তাড়াহুড়ো কিংবা কাজের চাপে ভুল করে নেগেটিভ এলে সমাজে আরও বিপদ ডেকে আনবে। এ জন্য দক্ষ ও পর্যাপ্ত লোকবলের বিকল্প নেই।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ সময়ের আলোকে বলেন, আমি তিন মাস আগে থেকে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বাড়ানোর কথা বলে আসছি। এখন জরুরি ভিত্তিতে তাদের নিয়োগ দেওয়া দরকার। কারণ টেস্ট না করতে পারলে রোগী শনাক্ত করা যাবে না। আর এ টেস্ট করবেন টেকনোলজিস্টরা। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল।

আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, ১২ বছর ধরে তাদের নিয়োগ বন্ধ। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় দ্রুত কিছু মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিতে হবে।

অন্যদিকে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের (ল্যাব) শূন্যপদে নিয়োগের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিএমটিএ)। সংগঠনের সদস্য সচিব মো. আশিকুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, করোনা শনাক্তে মূল ভূমিকা পালন করেন টেকনোলজিস্টরা। কিন্তু তাদের সংখ্যা একেবারে অপ্রতুল। প্রতি উপজেলায় মাত্র একজন টেকনোলজিস্ট করোনার নমুনা সংগ্রহের কাজ করছেন, যা তার পক্ষে খুবই কষ্টদায়ক। আবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ কমপক্ষে ১০ থেকে ২০টি নমুনা সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছেন। এতে অনেকেই হিমশিম খাচ্ছেন।
তিনি বলেন, যতই দক্ষ হোক না কেন, একার পক্ষে অনেক কাজ করলে গেলে ফলাফল নেগেটিভ আসতে পারে। আবার অনেক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পর্যাপ্ত সুরক্ষা পাচ্ছেন না। তাদের এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ করা হচ্ছে না। কিছুদিন আগে যশোরের একটি উপজেলায় এক টেকনোলজিস্টকে সার্জিক্যাল মাস্ক দিয়েই করোনা পরীক্ষার কাজে বাধ্য করা হয়।

শিগগিরই টেকনোলজিস্ট নিয়োগের দাবি জানিয়ে বিএমটিএ’র সদস্য সচিব বলেন, টেকনোলজিস্ট সঙ্কটের কারণে পরিস্থিতি আরও বেগতিক হতে পারে। সঙ্কট দূর করতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী উপজেলার কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রভাইডারদের (সিএইচসিপি) দিয়ে করোনার নমুনা শনাক্ত করতে বলছেন। কিন্তু আমরা তাতে দ্বিমত জানিয়েছি। কারণ তাদের নিয়ে করোনা ফলাফল সঠিক নাও আসতে পারে। তাই আমরা চাই যেকোনোভাবে কিছু টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া হোক।

বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশন বলছে, একযুগ ধরে অর্থাৎ ২০০৮ সাল থেকে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) পদে নিয়োগ বন্ধ। এতে দেশের অধিকাংশ টেকনোলজিস্টের পদই খালি। দেশের মোট পদের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। কিন্তু বর্তমানে কর্মরত আছেন প্রায় ১ হাজার ৭০০ জনের মতো। বাকি ৩ হাজার ৩০০ পদ শূন্য আছে। ফলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহভাজন রোগীদের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ জন্য সংগঠনটি মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদে নিয়োগ প্রদান অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া মেডিকেল টেকনোলজিস্টের অপ্রতুলতায় সাধারণ রোগীদেরও বিভিন্ন রিপোর্ট পেতে বেগ পেতে হচ্ছে। এর অভাবে খোদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্বিবিদ্যালয়েও জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনা মোকাবেলার পরীক্ষা সংক্রান্ত নির্দেশনা মানা যাচ্ছে না ল্যাব টেকনোলজিস্টদের সঙ্কটের জন্য। করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য পিসিএল ল্যাব দেশে সম্প্রসারণ করলেও সেখানে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নেই। বিশেষ করে যারা নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষা করার কাজে নিয়োজিত প্রশিক্ষিত দক্ষ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দেশে নেই। শুধু তা-ই নয়, বর্তমানে পিসিআর ল্যাব তৈরির জন্য সরকার যেসব প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারণ করেছে সেখানে দ্রুতগতিতে বায়োসেফটি লেভেল-২ (বিএসএল) ল্যাব তৈরি করা দরকার। এগুলো নিশ্চিত করা ছাড়া পরীক্ষা কার্যক্রমে যাওয়া টেকনোলজিস্টদের নিজের ও পরিবারের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
করোনাভাইরাসের মতো স্পর্শকাতর একটি ভাইরাসের পরীক্ষা করার মতো মানসিকভাবেও স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রস্তুত নন। শুধু তাই নয়, তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) ছিল না শুরুতে। এখন পর্যাপ্ত পিপিই সংগ্রহ করা হলেও তাদের মান নিয়ে খোদ স্বাস্থ্যকর্মীদেরই প্রশ্ন রয়েছে। কারণ পিপিইর মাস্ক এন-৯৫ মানের হওয়ার কথা থাকলেও ভেতরে তা পাওয়া যাচ্ছে না বলে অনেকেই অভিযোগ করছেন।

রাজধানীর উত্তরার একটি বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করেন টেকনোলজিস্ট জাফরুল আলম।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস, ডেঙ্গু, রক্তসহ ঝুঁ‌কিপূর্ণ সব পরীক্ষা করেন মে‌ডিকেল টেকনোলজিস্টরা। চি‌কিৎসক বা নার্সরা এ কাজটি করেন না। নানা অজুহাতে ১২ বছর ধরে আমাদের নিয়োগ বন্ধ আছে। অনেক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বেকার আছেন।

শুয়াইবুল কবির ইফাদ বলেন, বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বেশি বেশি পরীক্ষা করতে বললেও জেলায় নামমাত্র রোগীর নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। ফলে করোনা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যাচ্ছে না বলে তিনি মনে করেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রত্যেকটি উপজেলা থেকে দৈনিক ১০টি করে নমুনা পাঠাতে বলেছেন। সে হিসাবে কক্সবাজার জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহের সংখ্যা হওয়ার কথা পাঁচ শতাধিক। কিন্তু জেলা থেকে এ পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে দৈনিক মাত্র ২০ থেকে ৩০ জনের, যা মোট জনগোষ্ঠীর তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। আর মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের নিয়ে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ টেকনোলজিস্ট মো. জিল্লুর রহমানের।

আপনার মতামত দিন :