দেশে মোট করোনা আক্রান্তদের ১১% স্বাস্থ্যকর্মী

Shakil Shakil

Ahmed

প্রকাশিত: ১১:৫৩ পূর্বাহ্ণ, মে ১, ২০২০

দেশে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। মোট সংক্রমিত ব্যক্তিদের ১১ শতাংশই স্বাস্থ্যকর্মী। এই হার বৈশ্বিক হারের চেয়ে সাত গুণ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এমন সংক্রমণের কারণ জানার চেষ্টা করছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও গবেষকেরা মনে করছেন, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, মানসম্পন্ন সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) ও মাস্ক না পাওয়া, প্রশিক্ষণের ঘাটতির কারণে স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একাধিকবার বলেছে, স্বাস্থ্যকর্মীরা এই মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের সামনের সারির যোদ্ধা। এঁদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তাঁদের সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে অন্য সবার সুরক্ষা ঝুঁকিতে থাকবে।

সর্বশেষ ২৮ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, করোনা রোগী সেবার সঙ্গে জড়িত স্বাস্থ্যকর্মীরা ভাইরাস সংক্রমণ, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, মানসিক চাপ, কর্মক্লান্তি ও ভীতির ঝুঁকিতে আছেন। এ ছাড়া তাঁরা শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যারও শিকার হচ্ছেন। এসব বন্ধে বিশ্বের সব দেশ এবং সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। ওই দিন তারা আরও বলেছিল, সারা বিশ্বে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ৩৫ হাজারের বেশি স্বাস্থ্যকর্মীর সংক্রমণের তথ্য তারা পেয়েছে। ওই দিন পর্যন্ত সারা বিশ্বে আক্রান্ত ছিলেন ২৩ লাখ ৯৭ হাজার ২১৭ জন। অর্থাৎ তাঁদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মী ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

দেশে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট, ওয়ার্ডবয়, আয়ার সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে করোনায় একজন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসকদের কেন্দ্রীয় পেশাজীবী সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) সংক্রমিত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর নিয়মিত হিসাব রাখছে।

বিএমএর মহাসচিব মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত ৮৮১ জন স্বাস্থ্যকর্মীর করোনা শনাক্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে চিকিৎসক ৩৯২ জন, নার্স ১৯১ জন এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ২৯৮ জন। বাংলাদেশে মোট সংক্রমিত হয়েছেন ৭ হাজার ৬৬৭ জন। অর্থাৎ মোট সংক্রমণের ১১ শতাংশই স্বাস্থ্যকর্মী।

চিকিৎসক ও নার্স সংগঠনগুলোর তৎপরতার কারণে তাঁদের সংক্রমণের খবর বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর খবর সুনির্দিষ্টভাবে পাওয়া যায় না।

কোভিড–১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, এটা দুঃখজনক যে চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হচ্ছেন। সম্মুখ সারির সব কর্মীর পিপিই, কর্মঘণ্টা, বিশ্রাম, থাকা–খাওয়া, যাতায়াতসহ সব বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে আরও মনোযোগী হতে হবে।

হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, মানসম্পন্ন পিপিই ও মাস্ক না পাওয়া, প্রশিক্ষণের ঘাটতির কারণে সংক্রমণ বেশি।

স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্তের পরিস্থিতি

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বাংলাদেশে সংক্রমণের তথ্য প্রথম প্রকাশ করে ৮ মার্চ। আর প্রথম মৃত্যুর খবর জানা যায় ১৮ মার্চ। করোনায় প্রথম মৃত্যু হয়েছিল বেসরকারি হাসপাতালে। মৃত্যুর ঘটনার পর থেকেই চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সংক্রমণের বিষয় প্রকাশ পেতে থাকে।

গতকাল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক উত্তম কুমার বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, এ পর্যন্ত ওই হাসপাতালে ৪৬ জন চিকিৎসক, ৭ জন নার্স ও ১৩ জন কর্মচারীর করোনা শনাক্ত হয়েছে।

ঢাকার প্রায় সব বড় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সংক্রমণের খবর গণমাধ্যমে নিয়মিত বের হচ্ছে। রাজধানীর বাইরেও বিভিন্ন জেলায় একই ঘটনা ঘটছে।

কোনো জেলায় সাধারণ মানুষের চেয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা বেশি আক্রান্ত হয়েছেন এমন খবর পাওয়া গেছে। ময়মনসিংহ জেলায় ১৪৫ জন আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে ১০৭ জন বা ৭৪ শতাংশই হচ্ছে চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী। এঁদের ৮৩ জনই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের। এ নিয়ে গতকাল প্রথম আলোতে বিস্তারিত খবর ছাপা হয়েছে। এর আগে গত সপ্তাহে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল, কিশোরগঞ্জে আক্রান্তদের ৬৬ শতাংশই চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী।

সংক্রমণ শুরু হয়েছিল চীনে। দেশটিতে এ পর্যন্ত তিন হাজার চিকিৎসক ও নার্স আক্রান্ত হয়েছেন। অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর্মীরা মোট আক্রান্তের ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ৯ এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ৯ হাজার ২৮২ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছিলেন। দেশটিতে ওই সময় মোট আক্রান্তের ২ শতাংশ ছিলেন স্বাস্থ্যকর্মী।

কেন এমন হচ্ছে

বিএমএর মহাসচিব মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী মনে করেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণের প্রধান কারণ তিনটি। প্রথমত কে কে সংক্রমণমুক্ত, কে সম্ভাব্য করোনা রোগী এবং কে প্রকৃত রোগী—এটা বাছাই করার কোনো ব্যবস্থা হাসপাতালে নেই। দ্বিতীয়ত, শুরু থেকেই পিপিইর মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল। আবার সবাই পিপিই পাননি। যখন পেলেন, তখন তাঁদের ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। তৃতীয়ত, অনেক ব্যক্তি করোনার লক্ষণের বিষয় চেপে গিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও একই ধরনের কথা বলেছে। তারা বলছে, সেবার একটি পর্যায়ে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা জানতে পেরেছেন, কে রোগী আর কে রোগী নন, তাঁরা অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ বিভাগগুলোতে কাজ করেন, তাঁদের দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয়, অনেক কর্মী সংক্রমণ প্রতিরোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেন না (যেমন সঠিকভাবে পিপিই ব্যবহার করেন না, বা অনেকের হাত ধোয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অভ্যাস নেই)। এ ছাড়া অনেকের প্রশিক্ষণেরও ঘাটতি আছে।

পিপিই বা মাস্ক নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা বিশেষ করে চিকিৎসকেরা অভিযোগ করেছেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারে এমন পিপিই অনেক ক্ষেত্রে দেওয়া হয়নি। জীবাণুপ্রতিরোধী মাস্কও অনেকে ব্যবহার করতে পারেননি। অন্যদিকে বিশ্বসেরা মাস্কের নামে নকল মাস্ক সরবরাহের অভিযোগ উঠেছে।

এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ ও নাগরিক সংগঠন হেলথ ওয়ার্চ একটি জরিপ করেছিল। ১৮ এপ্রিল প্রকাশ করা ওই জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ২৫ শতাংশ চিকিৎসক ও নার্স কোনো পিপিই পাননি। যাঁরা পেয়েছিলেন, তাঁরা পিপিইর মান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না।

এখন করণীয়

একাধিক সূত্র বলেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঢাকা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাঁরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁরা খতিয়ে দেখতে চান, সংক্রমণের উৎস কোথায়—হাসপাতালে, যাতায়াতের গাড়িতে, বাসস্থানে, নাকি স্বাস্থ্যকর্মীদের সামাজিক মেলামেশার স্থানে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি।’

এদিকে ২৮ এপ্রিল জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভায় চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সুরক্ষা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সভায় পিপিইর মান নিয়ে কথা হয়। ওই সভায় পিপিইর মানের বিষয়ে কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলেছে, প্রতিটি দেশকে তার স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আর স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মক্ষেত্রে সঠিকভাবে পিপিই ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, কী করতে হবে এখন মোটামুটি সবারই জানা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থাপনা ও সরঞ্জামাদির বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে, যেন সুরক্ষার বাইরে কোনো চিকিৎসক বা কর্মী না থাকেন। কর্মীর দায়িত্ব, সুরক্ষার ব্যাপারে সচেতন আচরণ করা।

আপনার মতামত দিন :