কোভিড-১৯ সংকটে অক্সিজেন নিয়ে যত কথা – ডাঃ ফজলে এলাহী খাঁন।

Shahadat Shahadat

Hossain

প্রকাশিত: ১০:০৩ অপরাহ্ণ, জুন ১৪, ২০২০

দেশে করোনার প্রকোপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে । আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। বলা হয়ে থাকে করোনা সংকটে সংকটাপন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে অক্সিজেন। তাই আসুন জেনে এই সময়ে অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা,ব্যবহার ইত্যাদি।

পৃথিবীতে অক্সিজেন না থাকলে প্রাণের স্পন্দনও থাকত না। একে বাদ দিয়ে মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা কারো পক্ষেই বেঁচে থাকা সম্ভবপর নয়। তাই অক্সিজেনকে যদি জীবনদাতা বলা হয় তবে ভুল হবে না। আমরা এখন জানব, অক্সিজেন কাকে বলে? আর কেনই বা আমাদের পক্ষে এমন দরকারি? কীভাবে আমাদের কাজে লাগে?

অক্সিজেন হলো একটা গ্যাস বা বাষ্পীয় পদার্থ যা মানব জীবনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।রঙ-রূপ, স্বাদ, গন্ধ কিছুই নেই। এর আবিষ্কারক ১৮ শতকের দুজন বৈজ্ঞানিক। একজন ফরাসি, তার নাম ছিল আতোয়ান লোরা লাভোয়াজিয়ে। অপরজন ইংরেজ সোফে প্রিসলি। আমাদের চারপাশের বাতাসে সাধারণত অক্সিজেন থাকে প্রায় ২১ ভাগ আর থাকে প্রায় ৭৮ ভাগ নাইট্রোজেন। বাদবাকি ১ ভাগ নামমাত্র অন্যান্য গ্যাস। বাতাস ছাড়াও পৃথিবীর কঠিন বুকে অক্সিজেন মিশে থাকে বিভিন্ন ধাতুর সঙ্গে। আর তখন একে বলা হয় সেসব ধাতুদের অক্সাইড। একটা বিশিষ্ট চাপের মধ্যে অক্সিজেনকে মাইনাস ১৮৫ ডিগি সেন্টিগ্রেড তাপ দিলে তরল হয়ে যায়। তরল অবস্থায় এর রঙ দাঁড়ায় ফিকে নীল। মাইনাস ২১৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপে হয়ে যায় জমাট ঘন বস্তু।
অক্সিজেনের ব্যবহার : যদি রক্ত পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, আপনার রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ যা থাকা উচিত তার চেয়ে কম আছে তখন ওষুধের মতো অক্সিজেন ব্যবহার করতে হবে। অক্সিজেন এমন একটি গ্যাস যা মানব জীবনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এটি যে শ্বাস-প্রশ্বাসের বায়ুতে পাওয়া যায় এটির মধ্যে অন্যতম একটি গ্যাস। আপনার যদি দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগ হয় তবে আপনার অঙ্গগুলি স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে আপনার অতিরিক্ত (পরিপূরক) অক্সিজেনের প্রয়োজন হতে পারে।

এখানে কিছু রোগ বা অবস্থার কথা বলা হয়েছে যাতে অস্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদী পরিপূরক অক্সিজেনের প্রয়োজন হতে পারে:

সিওপিডি (দীর্ঘস্থায়ী পালমনারি রোগ)

পালমোনারি ফাইব্রোসিস

নিউমোনিয়া

মারাত্মক হাঁপানির আক্রমণ

সিস্টিক ফাইব্রোসিস

ঘুমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া(Sleep Apnea)

ক্লাস্টার হেডেক

যেকোনো ধরনের শক(shock)

হার্ট অ্যাটাক/ফেইলিউর

কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের বিষক্রিয়ায়, ইত্যাদি।

অক্সিজেন প্রয়োগের উপায়ঃঅক্সিজেন থেরাপি এমন একটি চিকিত্সা যা আপনাকে পরিপূরক বা অতিরিক্ত অক্সিজেন সরবরাহ করে। যদিও অক্সিজেন থেরাপি হাসপাতালে সাধারণ হতে পারে তবে এটি বাড়িতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়িতে অক্সিজেন সরবরাহ করতে ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি ডিভাইস রয়েছে। আপনার স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহকারী আপনাকে যে সরঞ্জামগুলি আপনার পক্ষে সবচেয়ে ভাল কাজ করে তা চয়ন করতে সহায়তা করবে।
সাধারণত নাকে নল দিয়ে বা একটি মুখোশের মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হয়ে থাকে।

অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম যেমন
CPAP
(কন্টিনিউয়াস পজিটিভএয়ারওয়ে প্রেসার),
BiPAP
(বাইলেবেল পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেসার),
HFNC
(হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলা)এবং
Ventilator(ভেন্টিলেটরের সাথে অক্সিজেন সংযুক্ত করে ব্যবহার করা যেতে পারে।)

অক্সিজেন সিলিন্ডার : অক্সিজেন সিলিন্ডার হচ্ছে অক্সিজেন রাখার জন্য লোহার তৈরি একটি বিশেষ পাত্র, যার ভেতরে অক্সিজেন উচ্চচাপে রাখা হয়। উচ্চচাপের ফলে অনেক পরিমাণ অক্সিজেন এ পাত্র ধারণ করে রাখে। মিনিটে এক লিটার অক্সিজেন দিলে এক মাঝারি ধরনের সিলিন্ডারে রোগী আনুমানিক ২২ ঘণ্টা অক্সিজেন পায়।নাকে নল দিয়ে সাধারণত এ অক্সিজেন দেয়া হয়ে থাকে।

অক্সিজেন কনসেনট্রেটর : এটি একটি মেশিন যেটা বিদ্যুৎ বা ব্যাটারির মাধ্যমে চালানো যায়। এ মেশিনটি বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে রোগীকে প্রদান করে। এ মেশিনে সাধারণত রোগীকে মিনিটে ৫ লিটার অক্সিজেনঃ

ECMO(extracorporeal membrane oxygenation)ঃএটি এমন একটি যন্ত্র যার মাধ্যমে রক্ত ​​আপনার শরীরের বাইরে এনে কৃওিম মেশিনে ফেলা হয় যা কার্বন ডাই অক্সাইডকে সরিয়ে দেয় এবং অক্সিজেন-পূর্ণ রক্তকে দেহের ভেতর আবার প্রবেশ করিয়ে দেয়।

এই পদ্ধতিটি রক্তকে হৃদ যন্ত্র এবং ফুসফুসকে “বাইপাস” করতে সাহায্য করে ।এই অঙ্গগুলিকে বিশ্রাম দেয় এবং নিরাময় করতে দেয়।

করোনায় (COVIT 19) যখন আপনার ফুসফুস একেবারে অকেজো হয়ে পড়ে তখন ভেনট্রিলেটর এর বদলে এটি বেশী কার্যকর। এবং আপনাকে ভীষণ খারাপ অবস্থা থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। ইন্ডিয়া সহ অন্য অনেক দেশে এ যন্ত্র ব্যবহার করে সুফল পাওয়া গেছে। আমাদের দেশে এখনও এ যন্ত্রের আগমন ঘটেনি।

তরল অক্সিজেনঃ তাপমাত্রা কমিয়ে গ্যাসীয় অক্সিজেনকে তরল অক্সিজেনে রূপান্তর করা হয়। এ অক্সিজেন রোগীকে দেয়ার সময় আবার গ্যাসে পরিবর্তন করে দেয়া হয়ে থাকে।

অক্সিজেন একটি ওষুধঃ আপনার জন্য অক্সিজেন একটি ওষুধ। কাজেই এটা ব্যবহার করতে হবে যেভাবে আপনার ডাক্তার পরামর্শ দেবেন। ডাক্তারের নির্দেশনা ছাড়া এর পরিমাণ ও সময়সীমা পরিবর্তন করবেন না।

অক্সিজেন ব্যবহারে সতর্কতাঃ অক্সিজেন দ্রুত আগুন জ্বালাতে এবং উত্তপ্ত করতে পারে, তাই অক্সিজেন ব্যবহারকালীন আগুন যেন লেগে না যায় সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নিম্নে কিছু সতর্কীকরণ পদক্ষেপ দেয়া হল:

❏ আগুন ধরতে পারে এমন দাহ্য পদার্থ যেমন—ম্যাচ, মোমবাতি, সিগারেট, গ্যাস বার্নার, ফায়ারপ্লেস বা অন্য কোনো দাহ্য পদার্থ এবং কোনো তাপের উৎস যেমন—স্পেস হিটার, স্টিম পাইপ, চুলা ও অন্য কোনো ঘর গরম রাখার যন্ত্র থেকে কমপক্ষে পাঁচ ফুট দূরত্বে অক্সিজেন সিলিন্ডারটি রাখুন।

❏ সিলিন্ডারকে সরাসরি সূর্যের আলো থেকে দূরে রাখুন।

❏ অক্সিজেন ইউনিটের কাছে কোনো ধরনের অ্যারোসল যেমন—এয়ারফ্রেশনার বা হেয়ার স্প্রে ব্যবহার করবেন না। অ্যারোসল একটি বিশেষ ধরনের দাহ্য পদার্থ।

❏ গ্যাসের চুলায় রান্না করার সময় চুলার কাছে অক্সিজেন ব্যবহার করবেন না।

❏ যে ঘরে অক্সিজেন আছে সে ঘরে ধূমপান করবেন না এবং অন্যকেও ধূমপান না করতে বলুন।

❏ অক্সিজেন ইউনিটটিতে কখনো তেল দেবেন না, তৈলাক্ত বা চর্বিযুক্ত হাত দিয়ে ধরবেন না।

❏ যখন অক্সিজেন ব্যবহার করবেন না, তখন সম্পূর্ণরূপে তা বন্ধ করে রাখুন।

 

লেখক

ডাঃ ফজলে এলাহী খাঁন (এনাম)

সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (কিডনী বিভাগ)

আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ, নোয়াখালী।

সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ রেনাল এসসিয়েশন।

সভাপতি, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)

নোয়াখালী জেলা শাখা।

আপনার মতামত দিন :