করোনা মানেই কি মৃত্যু?

প্রকাশিত: ১১:৫২ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১৩, ২০২০

করোনা মানেই মৃত্যু নয় প্রয়োজন সচেতনতা

বিশ্বজুড়ে মহামারীর রূপ পাওয়া নভেল করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে আতঙ্ক, সেই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে অসংখ্য গুজব। কোভিড-১৯-এর শুরুর দিকের লণগুলো হল জ্বর, কান্তি ভাব, শুষ্ক কাশি, শরীর ব্যথা, নাক বন্ধ, নাক দিয়ে পানি পড়া, গলাব্যথা ইত্যাদি; পাতলা পায়খানাও হতে দেখা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এসব লণের তীব্রতা বাড়ে এবং মৃদু থেকে তীব্র শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

আবার কারও কারো ক্ষেত্রে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরও কোনোরকম লণ প্রকাশ পায় না বা মৃদু লণ থাকতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। এর ফলে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং অর্গান বিপর্যয়ের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। অ্যাজমা রোগীর ক্ষেত্রে নভেল করোনাভাইরাস সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিপূর্ণ; যারা ইতিমধ্যে অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন, তাদের মধ্যে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটলে শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা আরও বাড়তে পারে।

ইমিউনিটি সিস্টেম যাদের দুর্বল বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম যেমন- ডায়াবেটিস, কিডনি বিকল, হৃদরোগী, শ্বাসকষ্টজনিত রোগে যারা ভুগছেন এবং বিশেষ করে বৃদ্ধরা মারাত্মক করোনা ঝুঁকিতে রয়েছেন। ধূমপায়ী পুরুষদের মধ্যে এই ভাইরাসের মারাত্মক প্রভাব ল করা যায়। ধূমপানের ফলে শ্বাসনালি ও ফুসফুসের কার্যমতা কিছুটা কম থাকে বিধায় এ ভাইরাস শ্বাসনালি ও ফুসফুসকে আক্রমণ করে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত এ ভাইরাসের উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে গড়ে পাঁচদিন সময় লাগে।

কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত কণার মধ্যে এই ভাইরাসটি থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি-কাশি দিলে তিন ফুটের মধ্যে কেউ থাকলে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। বাতাসে ভাইরাসটি ছড়ায় না, বরং শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত কণার মাধ্যমে ছড়ায়। কণাটি ভারি হওয়ায় এটি বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে না; তাই এটি মাটি, মেঝে বা অন্য কোনো বস্তুর ওপর পড়ে এবং দীর্ঘ সময় জীবিত থাকতে পারে।

সেখান থেকে স্পর্শের মাধ্যমে অন্য কারও করোনা সংক্রমণ হতে পারে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির সময় মুখে হাত দিলে বা কফ-থুতু হাতে লেগে গেলে এবং ওই হাত দিয়ে কোনো কিছু ধরা হলে, যেমন- টেবিল, চেয়ার, দরজার হাতল, কি-বোর্ড ইত্যাদিতে ভাইরাস থেকে যেতে পারে এবং এগুলো যে কেউ স্পর্শ করলে সেখান থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনো বস্তুর উপরিতলে এ ভাইরাস বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। এ জন্য বারবার ভালোভাবে হাত ধুয়ে নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

স্বাস্থ্যসেবা দানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি। চিকিৎসকরা প্রায়ই মুখে মাস্ক পরে থাকেন, তবে সাধারণ মানুষের বেলায় এর কার্যকারিতার তেমন কোনো প্রমাণ নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নভেল করোনাভাইরাস থেকে সুরায় তারা কোনো ফেস মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দিতে চান না। বরং নিয়মিত হাত ধুলে সুরতি থাকার সম্ভাবনা বাড়ে।

তবে কেউ আক্রান্ত হলে তার মাস্ক পরা উচিত, যেন তার মাধ্যমে অন্যদের সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো যায়। সুস্থ সাধারণ মানুষের মাস্ক ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, এই ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় না, বরং তা হাঁচি-কাশি এবং জীবাণুযুক্ত হাতের স্পর্শে বেশি ছড়ায়। তাই গণহারে রাস্তাঘাটে ঢালাও মাস্ক পরে চলাফেরার কোনো যুক্তি নেই। তবে মাস্ক তাদের জন্য পরা আবশ্যক, যারা মেডিকেল কর্মী এবং কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত এবং সংক্রমিত রোগীদের সংস্পর্শে যদি কেউ থাকে, এমনকি ফুর মতো কোনো লণ দেখা দিলে। যদি কারও কাশি ও সর্দি লেগে থাকে তবে তাকে মাস্ক পরতে হবে। মাস্ককে কখনোই বাইরে থেকে হাত দিয়ে স্পর্শ করবেন না। পেছন থেকে মাস্কটি খুলুন এবং অবিলম্বে এটি ঢাকনাসহ ডাস্টবিনে ফেলে দিন।

করোনা মানেই মৃত্যু নয় বা রোগটি নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই; তবে আমাদের সাবধানতাবশত কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে :
১. গণপরিবহন বা ভাড়ায়চালিত যানবাহনের ব্যবহার এড়িয়ে চলা।

২. ঘরে অবস্থানকালে পরিবারের অন্যদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে।

৩. আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি-কাশি দিলে ওই টিস্যু ব্যবহার করবেন না এবং টিস্যুটি পুড়িয়ে ফেলতে হবে, যাতে সেখান থেকে ভাইরাস না ছড়ায়।

৪. কেউ যদি রুমাল ব্যবহার করেন, তাহলে সেই রুমাল ও হাত সাবান দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নেবেন।

৫. বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে সাবান দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে দুই হাত ধুয়ে নেবেন অথবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে পারেন।

৬. করমর্দন, কোলাকুলি থেকে বিরত থাকুন এবং জনসমাগম এড়িয়ে চলুন। যথাসম্ভব ঘরে বা বাড়িতে থাকুন, খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হওয়াই ভালো।

৭. দেহে রোগ প্রতিরোধ মতা বাড়ানোর জন্য প্রতিদিন সুষম খাবার, টাটকা শাকসবজি ও ফলমূল খেতে হবে এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।

৮. ধূমপান ও মদ্যপান একদম নয়।

৯. খাবার ভালোভাবে সেদ্ধ করে খাবেন এবং শাকসবজি ভালোভাবে ধুয়ে নেবেন।

১০. ডিম পোচ করে না খেয়ে ভালোভাবে ভাজি করে খাওয়া উচিত।

১১. যেখানে সেখানে হাঁচি-কাশি দেবেন না এবং কফ-থুতু ফেলবেন না।

১২. যাদের হাঁচি-কাশি, এমনকি সর্দি হয়েছে, তারা মাস্ক ব্যবহার করবেন।

লেখকঃ
ডা. এম ইয়াছিন আলী
জনস্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক
কনসালটেন্ড ও বিভাগীয় প্রধান
প্রো-অ্যাকটিভ মেডিকের কলেজ ও হাসপাতাল,
চীফ- কনসালটেন্ড,ঢাকা সিটি ফিজিওথেরাপি হাসপাতাল
ধানমন্ডি, ঢাকা। মোবাঃ ০১৭৮৭১০৬৭০২

আপনার মতামত দিন :