করোনা আতঙ্কে করনীয়!

প্রকাশিত: ১২:৫০ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৪, ২০২০

করোনা সংক্রমণ হতে পারে অথবা করোনা সংক্রমণ রয়েছে এমন আতঙ্কে মানুষ এখন সত্যি তথ্য গোপন করছে। বিভিন্ন হাসপাতালে তথ্য লুকিয়ে চিকিৎসা নিতে আসছেন রোগীরা, আর তথ্য লুকানোর কারণে তাদের থেকে সংক্রমিত হচ্ছেন চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। এমনকি, করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে এমন ব্যক্তিরাও প্রায়শই প্রতিবেশীদের বিরূপ আচরণ এবং নানা ধরনের হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। মানুষকে স্টিগমাটাইডজ করে ফেলছে নতুন এই ভাইরাস।

মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ যদি একে কেবলই অসুস্থতা হিসেবে না নেয় তাহলে এই স্টিগমা কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ পরোক্ষভাবে বাড়িয়ে দেবে। মানুষ রোগ গোপন করে একেকজন বোমা হয়ে ঘুরে বেড়াবে। কেউ গোপন করলেই ভাইরাসটি আরও বেশি ছড়াবে। হেনস্তা হওয়ার ভয়ে মানুষ টেস্ট করাতে চাচ্ছেন না—কেবল এই স্টিগমার কারণে। বিশেষ করে সংবাদ সম্মেলন এবং মূলধারার গণমাধ্যমের সংবাদে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে সতর্ক না হলে এ থেকে মুক্তি মিলবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এ সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে শব্দচয়নে সাবধান হতে হবে আর স্টিগমা দূর করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দীন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কোভিড-১৯ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুরুতেই এ সংক্রান্ত গাইডলাইন দিয়েছিল, কিন্তু এ নিয়ে কথাই বলা হয়নি। তিনি বলেন, স্টিগমার জন্য নেতিবাচক সবকিছু বর্জন করতে হবে, এখন কেবল সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয় নয়, কোন খবরে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হবে সেটা বুঝতে হবে।

করোনা সংক্রমিত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের জানাজাতে কেউ নেই, রাস্তায় মানুষ পড়ে আছে, দাফনের জন্য কেউ নেই—গণমাধ্যমে মানুষ এগুলো যত দেখবে ততই তারা নেগেটিভলি রিইনফোর্সড হবে, তাই এগুলো বন্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে কোভিড-১৯ আক্রান্ত না বলে যদি কোভিড-১৯ সংক্রমিত মানুষ বলতে হবে।

আবার বয়স্কদের নিয়ে যে ধরনের প্রচার হচ্ছে সেটাও ক্ষতিকারক মন্তব্য করে ডা. হেলাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, যারা কোভিড-১৯-এ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন তাদের বয়স ৬০-এর ওপরে, তাদের সবারই কোনও না কোনও কোমরবিডিটি রয়েছে, এ কথাগুলোও তাদের ভেতর স্টিগমা তৈরি করে। এ ধরনের কথা বললে যারা এমন বয়সের রয়েছেন, যাদের কোমরবিডিটি রয়েছে তাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়, ভীতি তৈরি হয়, তাই এ ধরনের কথা বলা যাবে না।

এদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোনও ডকুমেন্টে কোভিড-১৯ ভাইরাসটির ছবি নেই জানিয়ে ডা. হেলাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, আমাদের দেশে যেকোনও বিজ্ঞাপনে, মূলধারার মিডিয়ায়, সচেতনতামূলক পোস্টারে বড় বড় করে ভাইরাসটির বীভৎস ছবি দেওয়া হচ্ছে, যেটা করা উচিত না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জনগণকে সচেতন বা প্রস্তুত করার জন্য যা প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল সেটা নেওয়া হয়নি। তবে এর সাংস্কৃতিক দিকও রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, যখন মানুষ দেখছে এ রোগে সংক্রমিত হয়ে মারা যাওয়ার পর তার জানাজায় মানুষ হচ্ছে না—এ ধারণা থেকেও মানুষ তথ্য লুকাচ্ছে। তাই এ বিষয়গুলো নিয়ে আরও আগে থেকেই সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন ছিল। এ ক্ষেত্রে সরকারি পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতির অভাব ছিল।

রাস্তায় মানুষ মরে পড়ে থাকছে এমন ধারণা মানুষের রয়েছে, আর ভুল তথ্য আর অবিশ্বাস মানুষকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে মন্তব্য করে সামিনা লুৎফা বলেন, মানুষ যখন ‘থানকুনি পাতা’ খেলে করোনাভাইরাস হবে না বলে নিশ্চিত থাকে তখন সরকারি মাইকিংয়ের চাইতে আরেকজন মানুষের কথা বিশ্বাস করে বেশি, এটাই ‘নেচার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সেলিম হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কোভিড সংক্রমিত হলেই যে কেউ অচ্ছুত হয়ে যায় না—এ বিষয়ে সরকার ও গণমাধ্যমকে আরও স্ট্রংলি প্রচার করতে হবে। তিনি বলেন, প্রতিদিন মৃত্যুর এবং আক্রান্ত হওয়ার সংবাদকে যেভাবে হাইলাইট করা হচ্ছে, সুস্থতার সংবাদ সেভাবে ফোকাস করা হচ্ছে না। সঠিক চিকিৎসা পেলে এটা ওভারকাম করা যায়, এ বিষয়গুলোকে গণমাধ্যমে ফোকাস করা হলে তখন মানুষ একটু হলেও সচেতন হবে, তখন তারা জানবে এর চিকিৎসা আছে, মানুষ সুস্থ হয়।

আবার শিক্ষার হার, কুসংস্কার এসবের কারণে স্টিগমাটাইজেশন থেকে বের হয়ে আসা খুব কঠিন মন্তব্য করে সেলিম হোসেন বলেন, মানুষ এখন জ্বরের কথা বলছে না। তাই সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে সরকার ও মিডিয়াকে। এটা এখন খুবই জরুরি।

আপনার মতামত দিন :