করোনা: শ্বাসতন্ত্রের কষ্টে ফিজিওথেরাপি কার্যকর!

প্রকাশিত: ৭:৪৯ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৮, ২০২০

করোনাভাইরাস দ্বারা শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণে সৃষ্ট রোগের নাম কোভিড-১৯। এই রোগে আক্রান্ত হলে একজন রোগীর তীব্র জ্বর, শুকনো কাশি, মৃদু থেকে তীব্র শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গ হয়ে থাকে। বৈশ্বিক চিকিৎসা গাইডলাইন অনুযায়ী করোনাভাইরাস দ্বারা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে ৩৪ শতাংশ রোগীদের অতিরিক্ত কফ শ্বাসতন্ত্রে জমা হয়, ১৯ শতাংশ রোগীর মৃদু থেকে তীব্র শ্বাসকষ্ট হয় এবং ৫ শতাংশ রোগীর ভেন্টিলেশন বা লাইফ সাপোর্ট প্রয়োজন হয়।

মৃদু সংক্রমণে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে পরামর্শ উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসক কর্তৃক পিসিআর, রক্তের সিবিসি পরীক্ষা করা এবং রোগ শনাক্ত হওয়ার পর ওষুধ গ্রহণ এবং বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। কোভিড-১৯ পজিটিভ হলে আপনাকে সম্পূর্ণ আইসোলেশনে থাকতে হবে। পারস লিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজ, রেসপিরেটরি মাসল ট্রেনিং এক্সারসাইজ এবং শ্বাসনালি ও ফুসফুসে জমে থাকা কফ সহজে বের করার জন্য ব্রিদিং এক্সারসাইজ করতে হবে এবং তারপর উপুড় হয়ে বিছানায় থাকতে হবে প্রতি ঘণ্টায় ২০ মিনিট। নাক দিয়ে যে সময় ধরে শ্বাস নেবেন, মুখ দিয়ে তার চেয়ে বেশি সময় ধরে শ্বাস ছেড়ে দেবেন, ধরা যাক ১: ২ সেকেন্ড। আপনি উপুড় হয়ে ব্রিদিং এক্সারসাইজ করলে শ্বাসনালিতে জমা আঠালো কফ পাতলা হবে এবং শ্বাসকষ্ট কম হবে। এ ছাড়া জিবের এক্সারসাইজ, ব্রিদিং এক্সারসাইজ, এরোবিক এক্সারসাইজ, বুক প্রসারিত করার এক্সারসাইজ ইত্যাদি করার মাধ্যমে রোগীদের ফুসফুসের আয়তনও বাড়বে এবং অনেক আরাম বোধ করবে।

মাঝারি থেকে তীব্র সংক্রমণের ক্ষেত্রে পরামর্শ এই কোভিড-১৯–এর মাঝারি সংক্রমণের ক্ষেত্রে বাসায় থেকে শ্বাসনালির ও ফুসফুসের কিছু এক্সারসাইজ করা যায়। কিন্তু রোগী যদি জ্বরের সঙ্গে অল্প শ্বাসকষ্টও বোধ করে, তাহলে হাসপাতালে যাওয়াটাই উত্তম কাজ এবং সেখানে অক্সিজেন থেরাপি নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে উপুড় হয়ে বা অর্ধশায়িত ভঙ্গিতে অল্প পরিসরে এক্সারসাইজ যেমন ব্রিদিং কন্ট্রোল্ড এক্সারসাইজ করতে পারেন। এখন জ্বর আছে, কিন্তু শ্বাসকষ্ট নেই, এ অবস্থায় ফুসফুসের শ্বাসনালিতে কফ জমে থাকার কারণে অস্বস্তিবোধ করছেন, তখন তাকে উপুড় করে অথবা হাফ লায়িং পজিশনে শোয়াতে হবে; এতে ফুসফুসে বাতাস প্রবেশের পথ সুগম হবে।

বিভিন্ন রকমের পশ্চারাল ড্রেনেজ টেকনিক, একটিভ সাইকেল অব ব্রিদিং এক্সারসাইজ, ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজ, ব্রিদিং কন্ট্রোলড এক্সারসাইজ—এই ধরনের চিকিৎসাসেবা একজন দক্ষ রেসপিরেটরি ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক রোগীর অবস্থা অনুযায়ী প্রদান করতে পারেন এবং মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিমের অন্য সদস্যের সঙ্গে নিয়েও করতে পারেন। উন্নত বিশ্বে যেমন ব্রিটেনে এই ধরনের রেসপিরেটরি চিকিৎসাসেবা পাওয়ার জন্য একজন চিকিৎসক ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞের কাছে রোগী রেফার করে থাকেন।

করোনা সংক্রমণে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তির পর রোগীকে দুই ঘণ্টা পরপর কাত করে শুইয়ে রাখা বিশেষ করে ডান কাত করে রাখলে ভালো অথবা উপুড় করে শুইয়ে রাখতে হবে। প্রথম দিন থেকে ভেন্টিলেটর ব্যবহারের আগের দিন পর্যন্ত রেসপিরেটরি ফিজিওথেরাপির ভূমিকা অপরিসীম। একটি রোগীকে যেন ভেন্টিলেটরে প্রবেশের আগেই অক্সিজেন থেরাপি, ব্রিদিং এক্সারসাইজ, পশ্চারাল ড্রেইনেজ, ম্যানুয়াল টেকনিক যেমন ভাইব্রেশন, শেকিং, ক্ল্যাপিং ইত্যাদি করলে রেসপিরেটরি ট্রাক্ট এবং ফুসফুসের জমে থাকা মিউকাস অনেকটা পাতলা হয়ে কাশির সাহায্যে অনেক সহজে বের করে আনা সম্ভব। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের বেলায় বিভিন্ন ব্রিদিং এক্সারসাইজের সঙ্গে সঙ্গে ডায়াফ্রামাটিক ম্যানুয়াল টেকনিক, রেসপিরেটরি মাসল স্ট্রেচিং এবং স্ট্রেন্দেনিং ইত্যাদি এক্সারসাইজ করিয়ে একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক ফুসফুসের সব সম্ভাব্য জটিলতা প্রতিরোধ করতে পারেন।

বিভিন্ন গবেষণায় ভেন্টিলেটরে যেসব রোগী আছে, তাদের উপুড় করে শুইয়ে রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপির ইন্সপাইরেটরি মাসল ট্রেনিং এক্সারসাইজগুলো করানো যেতে পারে। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় কোভিড-১৯–এর ক্ষেত্রে ফুসফুসের সংক্রমণে উপুড় হয়ে শুইয়ে থাকা কিংবা এই অবস্থায় অক্সিজেন থেরাপি নেওয়াটা কার্যকরী। রোগীকে নন–ইনভেসিভ ভেন্টিলেশনে রাখা, মেকানিক্যাল ইনটুবেশনে কিংবা মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন পর্যন্ত ফিজিওথেরাপির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আমরা জানি, যেসব রোগী ভেন্টিলেটরে যাবে এবং ২০ দিন থাকবে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। ভেন্টিলেশন খোলার পর রোগীর উইনিং পর্যায়ে প্রয়োজন অনুযায়ী রোগীকে যখন পর্যবেক্ষণ ওয়ার্ডে রাখা হয়, তখন রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে একজন দক্ষ ফিজিওথেরাপিস্টই পারেন স্ট্র্যাচিং এক্সারসাইজ, প্যাসিভ রেঞ্জ অব মোশন, বসা থেকে দাঁড়ানো, হাঁটানো ইত্যাদির মধ্যমে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে।

মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিমের সঙ্গে রেসপিরেটরি ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক একযোগে কাজ করলে রোগীর অনেক উপকার হবে। এই কোভিড-১৯–এর ক্ষেত্রে যেখানে অন্যান্য চিকিৎসা নড়বড়ে, সেখানে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। স্নাতক পর্যায়ে এবং পরবর্তী সময়ে ফিজিওথেরাপিস্টরা আইসিইউর যন্ত্রপাতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করে, অক্সিজেন স্যাচুরেশন, রেসপিরেটরি ক্যাপাসিটি, মেশিন রিডিং সিস্টেম সম্বন্ধেও তাদের জ্ঞান রয়েছে। তারপরও আইসিইউতে প্রবেশকালে এক দিন বা দুই দিন ট্রেনিং নেওয়া যেতে পারে।

এই মহামারির সময় ও অসুস্থতায় বাড়িতে থাকাই ভালো। শুধু জ্বরের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হলে হাসপাতালে যাওয়া উত্তম। ঘরোয়া চিকিৎসায় কাজ না হলে টেলিফোন বা টেলিমেডিসিনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। খুব জরুরি না হলে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে না যাওয়াই ভালো। করোনা পরিস্থিতিতে যাঁরা ঘরে অবস্থান করছেন, তাঁদের ফিজিওথেরাপি এবং পুনর্বাসনসেবার জন্য বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশন (www.bpa-bd.org) বিনা মূল্যে টেলিমেডিসিন কার্যক্রম চালু করেছে। আপনারা চাইলে যে কেউ ঘরে থেকে এই সেবা নিতে পারবেন।

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা আধুনিক ও গবেষণালব্ধ, যা উন্নত দেশের করোনা আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশের স্বাস্থ্য কাঠামোতে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্তি এখনো হয়নি। তাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিব, স্বাস্থ্য মহাপরিচালক এবং সব হাসপাতাল পরিচালকের কাছে বিনীত অনুরোধ করব, যেন কোভিড-১৯ চিকিৎসায় দক্ষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ সৃষ্টি করা হোক। ডায়াবেটিস এবং হাইপারটেনশসহ অন্যান্য রোগী, যারা হোম কোয়ারেন্টিনে আছে, তাদের দ্বারপ্রান্তে সঠিক এবং পূর্ণাঙ্গ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাব্যবস্থা পৌঁছে দেওয়া আমাদের মানবিক দায়িত্ব।

এহসানুর রহমান: ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ। সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ হেলথ প্রফেশনস ইনস্টিটিউট, সিআরপি, সাভার, ঢাকা।

সূত্রঃ প্রথম আলো।

আপনার মতামত দিন :