টানাটানির জীবন – জনাব ফোরকান ওয়াহিদ

Selim Selim

Reja Sobuj

প্রকাশিত: ১২:১০ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ২৮, ২০২০

গতরাত থেকে সকাল পর্যন্ত টানা ঘুমিয়ে গতরাতের টানানো মশারিটা খুলে বাথরুমের দরজাটা যেই টেনেছি সাথে সাথেই বউয়ের গলায় লম্বা টান “এই বাথরুমে বসে সিগারেট টানোনা কইলাম”। টানা প্রতিদিনই সিগারেট টানা নিয়ে এই এক কথা শুনতে কত আর ভালো লাগে বলুন। বেচারির আর কি দোষ, টানাটানির সংসারে সকাল বিকাল এটা ওটা টানাটানি করতে করতে টানার উপর তার রাজ্যের বিরক্তি।

অথচ এই মহিলার একসময় আমার প্রতি কি টানটাই না ছিল। টানা বিশ বছর আমার টানাটানির সংসারের বোঝা টানতে টানতে এখন তার টানের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। টানাটনির সংসারে থেকে অফিসে গিয়েও সেই টানাটানিতেই পড়তে হয়। এ টেবিল থেকে ও টেবিল ফাইল টানাটানি দিয়ে শুরু, এরপর কলিগদের টানা বকবকানি, বসের টানা ঝাড়ি, আর কত টানা যায় বলুন।

টানাটানির সাথে আমার সখ্যতা সে শৈশব থেকেই। জন্মের পরপর ফুফু, খালা, চাচীদের কোলে টানাটানি দিয়ে শুরু, তারপর থেকে টানাটানি চলছেই।নিন্মমধ্যবিত্ত বাবার টানাটানির সংসারে টেনেটুনে বেড়ে উঠা আমাদের টানাটানির হাত পেকেছে শীতের রাতে কাঁথা টেনে টেনে। এক কাঁথায় তিন/চার ভাইবোন ঘুমাতাম বিধায় টানাটানিতে যে বেশি সফল হতো তার ঘুমটা ততোধিক আরমদায়ক হতো। বাবা খেলনা কিংবা বল নিয়ে আসতো একটা, পাঁচ ভাইবোন এই এক খেলনা নিয়ে টানাটানি। প্রাইমারী লেভেলটা খাতা বই টানাটানি করে কোনমতে পার করি। ক্লাস টেনে পড়ার সময় পড়ার চেয়ে সিনেমার প্রতি টানটা বেশি থাকায় এসএসসি পাশ করি টেনেটুনেই। কলেজে গিয়ে নানাবিধ টানাটানির পরিমাণ বেড়েছে বই কমেনি। সায়েন্স, কমার্স, আর্টসের টানাটানিতে পড়ে সহপাঠিনীদের টানাটানা চোখের প্রতি অন্যরকম একটা টান যে অনুভব করিনি তা নয়। সে টানও অবশ্য এক জায়গায় স্থির ছিল না। কারো চোখের প্রতি টানতো, কারো চুলের প্রতি, কারো মেধার প্রতি টান তো কারো কণ্ঠের প্রতি– এভাবে টানাটানিতে পড়ে কাউকে আর কাছে টানা হয়নি সেসময়।

পড়ালেখা শেষ করে জীবনের টানে বেড়িয়ে পড়ি নাড়ির টান আলগা করে। বেকার অবস্থায় অবশ্য পকেটের টানাটানিটা লেগেই থাকতো। প্রতিদিন পত্রিকায় চাকুরির পাতা টানাটানি করে করে টেনশন বাড়তো বই কমতো না। ফলে টানাটানির টেনশন কমাতে গিয়ে হাতেখড়ি হয় সিগারেট টানায়। টুকটুাক যে অন্যকিছুও টানিনি সে কথা আজ হলফ করে বলার উপায় নেই।

চাকুরি পাওয়ার পরও টানাটানি অব্যাহত থাকে জীবনে। বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা নিয়ে টানাটানি। বাবা এক মেয়ের দিকে টানে তো মা টানে অন্য মেয়ের দিকে। এ নিয়ে বাবা-মার মন টানাটানি। আবার বাবা-মার টানা পাত্রীর দিকে মন টানে না আমার। কলেজ জীবনের টানাটানা চোখের সহপাঠিনীরা অবশ্য ততদিনে দুই/তিন বাচ্চার মা হয়ে নিজদের সংসার টানছেন। কোন সে এক অদৃশ্য টানে যে সেদিন বিয়ের বাঁধনে জড়িয়েছিলাম তা একমাত্র উপরওয়ালাই জানেন ( বি.দ্র. অফিসের উপরের তলাতেই আমার বাসা)। এখন বাজারের ব্যাগ টানতে টানতে দীর্ঘশ্বাস টানি আর ভাবি এভাবে সংসারের ঘানি আর কতদিন টানবো।

ব্যক্তিজীবনের মতো আমাদের জাতীয় জীবনও টানাটানিতে পূর্ণ। যাত্রীদের নিয়ে লোকাল বাসের হেলপারের টানাটানি, সদরঘাটে মালপত্র নিয়ে কুলিদের টানাটানি, রেলস্টেশনে টিকেট ব্ল্যাকারদের টানাটানি, ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে রোগীর ব্যবস্থাপত্র নিয়ে ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের টানাটানি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কোচিং ব্যবসায়ীদের টানাটানি চলেছেই । আইপিএল বিপিএল-এ ভাল খেলোয়াড়দের নিয়ে যেমন বিভিন্ন টিম টানাটানি করে তেমনি নির্বাচনের আগে যোগ্য প্রার্থীদের নিয়ে চলে ভিন্ন ভিন্ন দলের টানাটানি। আজ যিনি একদলের মনোনয়ন ফরম টেনেছেন কাল তিনি কিসের টানে অন্য দলের প্রধানের কাছে ফুলের তোড়া নিয়ে বুক টানটান করে ছবি তোলেন তা কেবল তিনিই জানেন। এরকম কিছু নেতার অবশ্য ভোটের পর জামানত নিয়েও টানাটানি পড়ে।

এভাবে বিবিধ টানাটানিতে অতিষ্ঠ জনগন যে একটু মুক্ত বাতাস টানতে বাইরে যাবেন সে উপায়ও এখন নেই। সেখানেও করোনার টানা উৎপাত। নিশ্বাসের টানে কিংবা অন্য কোনভাবে ভাইরাস যদি একবার নিজের শরীরে টেনে নেন, তবে তো যমে মানুষে টানাটানি। দরজা জানালা টেনে টানা কতক্ষণ থাকা যায়। মোড়ের দোকানে চা বিড়ি টানতে গিয়ে অনেকে ইতোমধ্যে আর্মি পুলিশের টানা পিটুনি খেয়েছেন শুনে বাইরে যেতে আর মন টানে না। যাদের অবশ্য ঘরে খাবার নেই তাদেরে তো পেটের টানে বাইরে যেতেই হয়। যদিও সরকার এবং কিছু মহৎ প্রাণ মায়ার টানে তাদের ত্রাণের ব্যবস্থা করেছেন তবে সে ত্রাণ নিয়েও মেম্বার চেয়ারম্যানদের টানাটানি চলছে। খাটের লেপ তোষক টানলেই মিলছে সারি সারি তেলের বোতল, গুদামের দরজা টানলে চালের বস্তা।

আমি আশাবাদী মানুষ, আশাকরি শীঘ্রই আমাদের টানাটানির এ দিন শেষ হবে। ভাইরাস – মানুষের টানাটানিতে মানুষের জয় হবে। আবার আমরা বন্ধুদের টানা বকবকানি শুনতে শুনতে বিড়ি টানবো, চায়ের কাপে লম্বা টান দিয়ে মেতে উঠবো পুরনো গল্পে। কোন সমস্যা, কোন দুঃখই টানা থাকে না। এক সময় পৃথিবী আবার স্বাভাবিক হবে, ততোদিন পর্যন্ত অসহায়দের প্রতি আমাদের হৃদয়ের টানটা যেন থাকে, আমাদের সহযোগীতায় তাদের পেটে যেন টান না পড়ে। যারা সত্যিকারের টানাটানিতেই দিনাতিপাত করছেন তাদের কাছে টেনে নিন ভালোবেসে, নিশ্চয় উপরওয়ালা আপনাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন।

লেখক,

জনাব,ফোরকান ওয়াহিদ

জেলার( কুমিল্লা জেল)

আপনার মতামত দিন :