করোনা চিকিৎসায় বিভ্রান্তির উত্তর খুঁজলেন বিবিসি বাংলার অনুসন্ধানী টিম

Emon Emon

Chowdhury

প্রকাশিত: ৯:৫০ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৪, ২০২০

বিশ্বের ১৬৮ দেশে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৬৪৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১৬ হাজার ৫৮৭ জন (জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়)। প্রতিদিন আক্রান্ত মানুষ ও মৃতের হার বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস ঠেকাতে নানা অপপ্রচার বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। এসব ভুয়া প্রচারে তাল দিয়ে অনেকে অসুস্থ হয়েছেন। মারাও গেছেন। ফলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্বাসযোগ্য নয় এমন মাধ্যমের তথ্য সংগ্রহ থেকে বিরত থাকুন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণবিষয়ক সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি), জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার সতর্ক করে দিয়েছে যে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কোনো ওষুধ নেই। তারা বলেছে, এসব ভুয়া তথ্যের মাধ্যমে নেওয়া কোনো পদ্ধতি গ্রহণ, সেবন বা পান করলে জীবনও সংশয়ের মধ্যে পড়তে পারে। তাঁদের মত, এভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে তাঁরা নিজেদের মুক্ত করতে পারবে না।

বিবিসির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিভাগ রিয়্যালিটি চেক সংক্রমণ ঠেকানোর কয়েকটি দাবি যাচাইবাছাই করেছে। করোনাভাইরাস নিয়ে প্রচলিত এমন কয়েকটি বিষয় নিয়ে এখানে আলোচনা করা হলো।

বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে যে, কোনো ব্যক্তি যদি ১০ সেকেন্ড নিশ্বাস বন্ধ করে থাকে এবং ওই সময় যদি তিনি কোনো কষ্ট অনুভব না করেন, তাহলে বুঝতে হবে তার ফুসফুসে কোনো ফাইব্রোসিস নেই। অর্থাৎ ফুসফুসের টিস্যু বা কলায় কোনো ক্ষতি হয়নি, বা স্বাভাবিকের তুলনায় মোটা হয়ে যায়নি। এর অর্থ হলো ফুসফুসে সংক্রমণ নেই।

বিবিসির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিভাগ রিয়্যালিটি চেক সংক্রমণ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছেন, এই দাবি সঠিক নয়। এর কারণ হলো ফুসফুসে ফাইব্রোসিস হয়েছে কি না তা নিশ্বাস বন্ধ করে পরীক্ষা করা যায় না। আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, ফাইব্রোসিস করোনাভাইরাস ভাইরাস বা কোভিড-১৯ সংক্রমণের কোনো উপসর্গ নয়। কেউ যদি ১০ সেকেন্ডের এ রকম একটি পরীক্ষা করে নিজেকে নিরাপদ মনে করেন তাহলেই বরং তার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘কোভিড ১৯’ বা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার প্রধান উপসর্গ হচ্ছে খুব বেশি জ্বর এবং সঙ্গে একনাগাড়ে কাশি।

ঘরে হ্যাণ্ড স্যানিটাইজার তৈরির প্রণালি

হাত জীবাণুমুক্ত করার জন্য ঘরে বসেই স্যানিটাইজার তৈরির যেসব প্রণালি ইন্টারনেটে ছড়ানো হচ্ছে সেগুলো থেকে সাবধান। কোনো আসবাবপত্র বা টেবিল বা যেসব জিনিসে আপনি হাত দিচ্ছেন সেগুলো জীবাণুমুক্ত করার জন্য মোছার যেসব বস্তু পাওয়া যায় সেগুলো আপনার ত্বকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

মদ পান কী করোনা প্রতিরোধ করে?

ইরানে ২৩ হাজার ৪৯ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে মারা গেছেন ১ হাজার ৮১২ জন। প্রতিদিনই ইরানে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্বে যেসব দেশে করোনাভাইরাস সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত হয়েছে তার মধ্যে ইরান অন্যতম। ইরানের জনগণের মধ্যে প্রবল ধারণা দেশটির সরকার করোনাভাইরাস সংক্রমণের মাত্রা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিচ্ছে না। ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

এর বড় কারণ হলো, ইরানের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গত ২১ ফেব্রুয়ারি। এই নির্বাচনের আগে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে সরকার মুখ খোলেনি। বিপুল মানুষ নির্বাচনে ভোট দিতে এসে ও প্রচারে যোগ দিয়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশটির সরকারের একজন উপদেষ্টা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।

ইরানে ফেব্রুয়ারি মাসে দুটো বড় ঘটনা ঘটে যায়। একটি ইসলামিক অভ্যুত্থানের ৪১ বছর পূর্তি অন্যটি দেশটির সংসদ নির্বাচন। ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানের বিজয় দিবস। এর কিছুদিন আগেই ইরানে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।

ইরানে সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে নানা অপপ্রচারের খপ্পরে পড়ছেন। এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো, মদ পান করলে করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকা যায়। দেশটিতে অ্যালকোহলিক স্পিরিট, ওয়াইন এবং বিয়ার পান নিষিদ্ধ। তবুও দেশটির অনেক লোক নিয়মিত মদপান করেন। এভাবে বিষাক্ত মদ পান করে ইরানে ১০০ জন মারা গেছেন বলে ব্লুমবার্গের দাবি।

অনেকে বলছেন মধ্য পানীয় ‘ভদকা’ জীবাণুনাশকের কাজ করবে। তবে বাস্তবে বিষয়টি মোটেও তা নয়। ভদকাতে যথেষ্ট পরিমাণ অ্যালকোহল নেই যা জীবাণু মারার জন্য প্রয়োজন। আর উচ্চ মাত্রার অ্যালকোহল পান করলে উল্টো স্বাস্থ্যঝুঁকি পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

করোনাভাইরাসের আয়ু এক মাস?

বিভিন্ন মাধ্যমে বলা হচ্ছে, কোনো সারফেসের ওপর বা যেকোনো জায়গার ওপর ভাইরাস এক মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকে। কোনো কঠিন বস্তু থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি ৭২ ঘণ্টা পর ব্যাপকভাবে কমে যায়। এই দাবি একদমই ঠিক নয়।

সার্স বা মার্সের মতো করোনাভাইরাস নিয়ে আগে যেসব গবেষণা হয়েছে তাতে দেখা গেছে, কঠিন কোনো জায়গার ওপর যেমন ধাতুর তৈরি, কাচ বা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি কোনো সারফেসের ওপর করোনাভাইরাসের জীবাণু বেঁচে থাকে প্রায় দুই ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ নয় দিন।

ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের গবেষণাকে উদ্ধৃত করে ব্রিটিশ সরকার বলেছে, কোনো কঠিন বস্তু স্পর্শ করলে যেমন টেবিলের ওপর, হ্যাণ্ড রেলিং বা এ ধরনের অন্য কিছু, সেখান থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি ৭২ ঘণ্টা পর ব্যাপকভাবে কমে যায়।

গোমূত্র পান কি করোনা প্রতিরোধ করতে পারে?

ভারতে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু গোষ্ঠী মনে করে গোমূত্রের এমন কিছু চিকিৎসা গুণ রয়েছে যা করোনাভাইরাস এবং অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন গোমূত্রের এমন কোনো গুণ নেই। গোমূত্র করোনা ভাইরাস বা কোভিড ১৯ ঠেকাতে সক্ষম এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই

বিশেষজ্ঞরা বলছেন গোমূত্র যেমন ক্যানসার সারায় না, তেমনি গোমূত্র ‘কোভিড ১৯’ ঠেকাতে সক্ষম এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই।

মানুষ থেকে মানুষের দেহে এই ভাইরাস কীভাবে ছড়ায় সে বিষয়ে এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।

ঘন ঘন পানি পান করলে করোনা যাবে না

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটি পোস্ট ছড়িয়ে দিয়ে বলা হয়, প্রতি ১৫ মিনিট পর পর পানি পান করুন। এতে গলার মধ্যে থাকা ভাইরাস পাকস্থলীতে চলে যাবে। পাকস্থলীতে থাকা অ্যাসিড ভাইরাস মেরে ফেলবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়টি এত সহজ না। এটি অতি সরলীকরণ।

লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ভাইরাস বিশেষজ্ঞ সহকারী অধ্যাপক কল্পনা সবাপাত্রী (Kalpana Sabapathy) বলেন, বিষয়টি অতি সরলীকরণ। সে কারণে এসব নিয়ে মাথাও ঘামাতে চাই না। তিনি বলেন, যদি কারও মুখ দিয়ে ভাইরাস পেটে যায় তাহলে সেটি দু একটি নয়, লাখ লাখ ভাইরাস প্রবেশ করে। পানি পান করার সময় সামান্য পরিমাণ ভাইরাসই পাকস্থলীতে যাবে। তা ছাড়া শুধু মুখের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে না। চোখ ও নাকের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে ঘনঘন পানি পান করে করোনাভাইরাস কোনোভাবেই আটকানো যাবে না। এ ছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের ৫০ শতাংশই মুখ, নাক, চোখ থেকে সংক্রমিত হয়েছে।

তবে যারা হালকা গরম পানি দিয়ে দিনে তিনবার গারগল করেন এমন ব্যক্তি শ্বাসরোগে কম আক্রান্ত হন বলে দেখা গেছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া করোনা ভাইরাস বা ‘কোভিড ১৯’ কোন কাজ দেবে না।

রসুন খেলে কাজ হবে না

রসুন খেলে করোনা ভাইরাসকে প্রতিরোধ করা যাবে এমন পরামর্শ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে রসুন খেলে করোনা ভাইরাস বা ‘কোভিড ১৯’ থেকে বাঁচা যায় এটি পরীক্ষায় প্রমাণিত না। রসুন স্বাস্থ্যের জন্য খুব ভালো একটি খাবার। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে চীনের এক নারী দেড় কেজি রসুনের গরম রস পান করে অসুস্থ হন। এরপর তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন।

থানকুনি পাতায় করোনা প্রতিরোধ হয় না

দেশের বিভিন্ন জেলায় হঠাৎ করে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, তিনটি থানকুনি পাতা খেলে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। তবে ফজরের নামাজের আগেই এই পাতা খেতে হবে। গত ১৭ মার্চ রাতেই দেশের বিভিন্ন স্থানে থানকুনি পাতা খাওয়ার হিড়িক চলে। কোথাও কোথাও থানকুনি পাতা খেতে মাইকযোগে আহ্বান জানানো হয়।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বহু বছর ধরে থানকুনি পাতা বাংলাদেশের মানুষ সবজি হিসেবে খেয়ে আসছেন। সবজি হিসেবে এর পুষ্টিগুণ অনেক ভালো। কিন্তু এতে ‘কোভিড ১৯’ প্রতিরোধ করতে পারে এমন কোনো গবেষণা নেই। বিষয়টি স্রেফ গুজব।

পরীক্ষা, হাত ধোয়া এবং বাসায় থাকা

দক্ষিণ কোরিয়াতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর প্রথমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এরপরেই দেশটি নাটকীয়ভাবে করোনা ভাইরাসকে আটকে দিতে সমর্থ হয়। এর কারণ হলো ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা। উপসর্গ দেখা দিক বা না দিক দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার প্রতিদিন বিনামূল্যে ১০ হাজার লোকের পরীক্ষা করছে। এ কারণেই দেশটিতে সংক্রমণ প্রায় আটকে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

সিডিসি বলছে, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া একটি কার্যকর উপায়। অন্তত ২০ সেকেন্ড সময় নিয়ে সামান্য মেখে হাত ধোয়ার পরামর্শ দিয়েছে তারা। পানি ও সাবান যেসব স্থানে নেই বা ব্যবহার করা কঠিন এ রকম পরিস্থিতিতে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে।

মুখে টিস্যু বা কাপড় দিয়ে ঢেকে হাঁচি কাশি দিন। যদি টিস্যু বা কাপড় না থাকে তাহলে নিজের বাহু দিয়ে ঢেকে হাঁচি কাশি দিন। হাঁচি কাশিতে ব্যবহৃত টিস্যু বা কাপড় ঢাকনাযুক্ত আবর্জনা রাখার বিনে ফেলুন। এগুলো পরে পুড়িয়ে ফেলুন। সব থেকে ভালো নিজের ঘরে গৃহবন্দী থাকা। এটি ভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর একটি পথ।

আপনার মতামত দিন :