করোনাভাইরাসের দ্রুত বিস্তারের রহস্যটা কি?

প্রকাশিত: ১২:৩৫ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১৬, ২০২০

করোনাভাইরাসের দ্রুত বিস্তারের রহস্যটা কি?

সার্স ভাইরাস (SARS-Cov) এবং নোভেল করোনাভাইরাস (SARS-Cov-2) একই গোত্রের ভাইরাস হওয়ার সত্বেও নোভেল করোনাভাইরাসটি কেন এত দ্রুত গতিতে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো, তা এখনও রয়ে গেছে অনেকটাই অজানা।

২০০৩ সালে সার্স মহামারীতে বিশ্বব্যাপি মোট আক্রান্ত হয়েছিল মাত্র ৮ হাজার এবং মারা গিয়েছিল প্রায় ৮০০ জন। অন্যদিকে আজকের পরিসংখান অনুযায়ী (৫ নভেম্বর ২০২০) নোভেল করোনাভাইরাসে গোটা বিশ্বে সংক্রমিত হয়েছে প্রায় ৪ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ এবং মারা গেছে ১২ লক্ষের উপরে।

বর্তমানে নোভেল করোনাভাইরাসের রিপ্রোডাকশন রেট (R0) বা একজন থেকে অন্যজনে সংক্রমণের হার হচ্ছে ২-৩.৬ অর্থাৎ, করোনাভাইরাস একজন থেকে সর্বচ্চ সাড়ে তিন জনের মাঝে ছড়াতে পারে। সার্স ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই রিপ্রোডাকশন রেট ছিল ২-৩।
এখানেই শেষ নয়। করোনা মহামারীর প্রথম ঢেউয়ের তান্ডব শেষ না হতে হতেই গোটা ইউরোপ জুড়ে শুরু হয়েছে মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ। দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণের তীব্রতা প্রথম ঢেউয়ের চেয়েও অনেক বেশী বলে মনে হচ্ছে। উত্তর আমেরিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ভারতে করোনাভাইরাসের বিস্তার কোনভাবেই কমছে না। বিশ্বব্যাপি করোনাভাইরাসের উপর গবেষণাও অব্যাহত রয়েছে বিস্তর। মহামারীর শুরু থেকেই বিজ্ঞানীরা বোঝার চেস্টা করছেন নোভেল করোনাভাইরাসের গঠন, এর সংক্রমণ ও বংশবিস্তার পদ্ধতি, এবং এর জেনেটিক মিউটেশন বা রূপান্তর।

জেনেটিক সিকুয়েন্সের দিক দিয়ে নোভেল করোনাভাইরাসের সাথে সার্স ভাইরাসের সাদৃশ্য রয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। তবে গঠনগত দিক দিয়ে এই দুটি ভাইরাসের মিল রয়েছে আরো বেশী। দুটি ভাইরাসই খোলকে মোড়া (enveloped) আরএনএ ভাইরাস। দুটি ভাইরাসই পোষক দেহের কোষকে সংক্রমণের জন্য ব্যবহার করে তাদের খোলকে থাকা প্রধান একটি প্রোটিন ‘স্পাইক প্রোটিন’।
এই স্পাইক প্রোটিনের মাধ্যমেই ভাইরাসদুটি মানুষের শ্বাসযন্ত্র ও অন্যান্য অঙ্গের কোষের গায়ে থাকা এসিই-টু রিসিপ্টরের সাথে আটকে যায় এবং পরবর্তিতে কোষের ভেতরে প্রবেশ করে রিপ্লিকেশন বা বংশ বিস্তার করে। সার্স এবং নোভেল করোনাভাইরাসের বংশ বিস্তার পদ্ধতি অনেকটা একই রকম। তবে পার্থক্য রয়েছে স্পাইক প্রোটিনের গঠন, রিসিপ্টরের সাথে এর বন্ধন সৃস্টি, আসক্তি এবং কোষের ভেতরে এর প্রবেশ করার প্রক্রিয়ায়। বিজ্ঞানীদের ধারনা এই পার্থক্যগুলোর কারনেই নোভেল কররেনাভাইরাসটি এর পূর্বসূরি সার্স ভাইরাসের চেয়ে এত দ্রুত সংক্রমণ বিস্তারে সক্ষম।

স্পাইক প্রোটিন হচ্ছে করোনাভাইরাসের কোষকে সংক্রমণ করার মোক্ষম হাতিয়ার। এই প্রোটিনটির দুইটি অংশ। একটি অংশকে বলে এস-১ সাবইউনিট এবং আরেকটি অংশকে বলে এস-২ সাবইউনিট। প্রোটিনের এই দুটি সাবইউনিট পরস্পর সুংযুক্ত থাকে একটি ছোট্ট প্রোটিন অংশ দিয়ে, যাকে বলে এস-১/এস-২ ক্লিভেজ। স্পাইক প্রোটিনের সবচেয়ে কার্যকরী এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হচ্ছে রিসিপিটর বাইন্ডিং ডোমেইন (RBD), যা অবস্থান করে এস-১ সাবইউনিটের একদম শেষ প্রান্তে।

এই রিসিপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনের মাধ্যমেই স্পাইক প্রোটিন তথা ভাইরাসটি এর রিসিপ্টরের সাথে বন্ধন সৃস্টি করে। এবং এই ডোমেইনটি খুবই ইমিউনোজেনিক; অর্থাৎ ভাইরাস মানব শরীরে প্রবেশ করার পর শরীরের ইমিউন সেলগুলি এই আরবিডি ডোমেইনের বিপরীতে ইমিউন রিঅ্যাকশন শুরু করে। অন্যদিকে, স্পাইক প্রোটিনের এস-২ সাবইউনিটের শেষ প্রান্তটি প্রথিত থাকে ভাইরাসের এনভেলপ বা খোলকের ভেতরে।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে নোভেল করোনাভাইরাসের রিসিপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনের এসিই-টু রিসিপ্টরের প্রতি আসক্তি পূর্ববর্তী সার্স ভাইরাসের চেয়ে অনেক বেশি। তবে ত্রিমাত্রিক ক্রিস্টাল স্ট্রাকচার অ্যানালাইসিসে দেখা যায় যে নোভেল করোনাভাইরাসের রিসিপিটর বাইন্ডিং ডোমেইন অংশটি বেশিরভাগ সময়ই পূর্ণ বা আংশিক বন্ধ অবস্থায় থাকে, যেখানে সার্স ভাইরাসে তা থাকে সবসময় খোলা বা উন্মুক্ত।
আর সম্ভবত এর ফলেই নোভেল করোনাভাইরাস শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে ফাঁকি দিয়ে সহজেই কোষের মধ্যে প্রবেশ করে এবং সংক্রমণ ঘটায়। এসিই-টু রিসিপ্টর ছাড়াও কোষের গায়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন ‘টাইপ-টু ট্রান্সমেমব্রেন সেরিন প্রোটিয়েজ’ (TMPRSS2) থাকে যা রিসিপিটর বাইন্ডিং ডোমেইনকে সক্রিয় করার মাধ্যমে ভাইরাসকে কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। এই সেরিন প্রোটিয়েজটি অবশ্য সার্স এবং নোভেল করোনাভাইরাস উভয়ের ক্ষেত্রেই একই ভাবে কাজ করে।

তবে, এই দুটি ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে সবচেয়ে বড় পার্থক্যটি পাওয়া গেছে এস-১/এস-২ ক্লিভেজ অংশটিতে। নোভেল করোনাভাইরাসের এই অংশটি প্রো-প্রোটিন কনভার্টেজ এনজাইমের বিক্রিয়ার জন্য বেশ উপযোগী স্থান। যে এনজাইমটি এই অংশের উপর বিক্রিয়া করে স্পাইক প্রোটিনটিকে উদ্দিপ্ত বা সক্রিয় করে সেই এনজাইমটিকে বলে প্রো-প্রোটিন কনভার্টেজ ফিউরিন, বা সংক্ষেপে ফিউরিন। এই ফিউরিন মানব কোষে থাকে পর্যাপ্ত পরিমানে।

গবেষণায় দেখা গেছে নোভেল করোনাভাইরাস যখন কোষের ভেতরে বংশ বৃদ্ধি করে তখন তার স্পাইক প্রোটিনটি ফিউরিনের বিক্রিয়াতে প্রি-অ্যাকটিভেটেড বা প্রাক-সক্রিয় হয়ে উঠে। এর ফলে নতুন তৈরী হওয়া করোনাভাইরাস খুব সহজে এবং দ্রুত গতিতে নতুন কোষকে সংক্রমণ করতে পারে।
অন্যদিকে, সার্স ভাইরাসের এস-১/এস-২ ক্লিভেজ অংশটিতে ফিউরিন এনজাইমটি কোন বিক্রিয়া করেনা। ফলে রিপ্লিকেশনের সময় সার্স ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনটি প্রি-অ্যাকটিভেটেড হয়না। বিজ্ঞানীদের ধারনা স্পাইক প্রোটিনের এই প্রি-অ্যাকটিভেশনের তারতম্যের কারনেই নোভেল করোনাভাইরাস সার্স ভাইরাসের চেয়ে এত দ্রুত এবং কার্যকর ভাবে এক কোষ থেকে আরেক কোষ এবং একজন থেকে আরেকজনে ছড়িয়ে পরছে (PNAS, মে ২০২০)।

এছাড়াও অতিসম্প্রতি জার্মানির টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক নিউরোপিলিন-১ নামের আরেকটি রিসিপ্টরের সন্ধান পেয়েছে যা নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং বিস্তারকে ত্বরান্বিত করে। এ বছরের ২০ অক্টোবর সাইন্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রটিতে দেখা যায় কোষের বহিরাবরনে থাকা নিউরোপিলিন-১ রিসিপ্টরটি ফিউরিন এনজাইম কর্তৃক খন্ডিত স্পাইক প্রোটিনের এস-১/এস-২ ক্লিভেজ অংশের সাথে এক ধরনের বন্ধন সৃস্টি করে, আর এই বন্ধন সৃস্টির মাধ্যমে নিউরোপিলিন-১ রিসিপ্টর ভাইরাসটিকে টেনে এসিই-টু রিসিপ্টরের কাছে নিয়ে যায় এবং ভাইরাসটিকে কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশে সহায়তা করে। আমাদের শ্বাস যন্ত্রের এপিথেলিয়াল কোষে সাধারাণত এসিই-টু রিসিপ্টরের সংখ্যা অনেক কম থাকে, তবে নিউরোপিলিন-১ রিসিপ্টর থাকে পর্যাপ্ত। আর এভাবেই নিউরোপিলিন-১ রিসিপ্ট মূলত করোনাভাইরাসকে তার কাংক্ষিত এসিই-টু রিসিপ্টরটি খুঁজে পেতে সাহায্য করে।

গবেষণায় দেখা গেছে আমাদের নাকের মিউকাস ঝিল্লির কোষে এবং ঘ্রান আহরনের নার্ভে (অলফেক্টরি নার্ভ) পর্যাপ্ত পরিমানে নিউরোপিলিন-১ রিসিপ্টর থাকে। নাসারন্ধ্র হচ্ছে আমাদের শ্বাসযন্ত্রে করোনাভাইরাস প্রবেশের প্রধান পথ। আর এই প্রবেশ পথেই থাকে নিউরোপিলিন-১ রিসিপ্টরের আধিক্য। এতে করে ভাইরাস আমাদের নিশ্বাসের সাথে নাকে প্রবেশ করে খুব সহজেই আটকে যায় নাকের মিউকাস ঝিল্লির কোষে এবং সেখানে বংশ বিস্তার করে। বংশ বিস্তারের পরে ভাইরাস ছড়িয়ে পরে ফুসফুসে এবং কাশি বা হাঁচির সাথে বাতাসে, যা পরবর্তিতে অন্য মানুষকে আক্রান্ত করে। এধরনের ঘটনা পূর্বের সার্স ভাইরাসের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়নি। সুতরাং বিজ্ঞানিদের ধারনা নিউরোপিলিন-১ রিসিপ্টর হচ্ছে দ্বিতীয় প্রধান পন্থা যার মাধ্যমে নোভেল করোনাভাইরাস এত দ্রুত গোটা বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পরেছে।

করোনাভাইরাস শুধু ফুসফুসেই সংক্রমণ করেনা; বরং তা মস্তিস্কেও আক্রান্ত করতে পারে। ভাইরাসটি কিভাবে মস্তিস্কে প্রবেশ করে তা এখনও ঠিক পরিস্কার না। তবে ধারনা করা হয় নাকের মিউকাস ঝিল্লিতে উন্মুক্ত থাকা অলফেক্টরি নার্ভের মাধ্যমে ভাইরাসটি ব্রেইনে প্রবেশ করে থাকতে পারে। এবং এক্ষেত্রেও নিউরোপিলিন-১ রিসিপ্টর একটি মোক্ষম ভুমিকা পালন করে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা এই নিউরোপিলিন-১ রিসিপ্টরকে টার্গেট করে করোনার বিপরীতে ওষুধ প্রস্তুতির চিন্তাভাবনা করছেন। কোন রাসায়নিক মলিকিউল বা মনোক্লোনাল এন্টিবডি দিয়ে নিউরোপিলিন-১ রিসিপ্টরকে ব্লক করার মাধ্যমে করোনাভাইরাসকে কোষে প্রবেশে বাঁধা প্রদানের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ রোধ করা যেতে পারে।

এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী দেখা যায় যে নোভেল করোনাভাইরাসের রিসিপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনের এসিই-টু রিসিপ্টরের প্রতি অতি আসক্তি, এস-১/এস-২ ক্লিভেজ অংশটির অত্যাধিক সক্রিয়তা এবং নিউরোপিলিন-১ রিসিপ্টরের সাথে বন্ধন সৃস্টির সক্ষমতাই ভাইরাসটিকে এত দ্রুত বিস্তারে সহায়তা করছে। ভাইরাসের এসব অংশকে টার্গেট করে বিজ্ঞানীরা ওষুধ এবং ভ্যাকসিন প্রস্তুত করছেন। সম্প্রতি রিসিপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনকে টার্গেট করে একধরণের মনোক্লোনাল এন্টিবডি থেরাপী তৈরী করা হয়েছে যা ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে বেশ কার্যকরী ফলাফল দেখিয়েছে। এছাড়াও বেশীরভাগ করোনা ভ্যাকসিনও তৈরী করা হয়েছে ভাইরাসের এ অংশটিকে লক্ষ্য করে।

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম,
এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি,
সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট,
শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য।

আপনার মতামত দিন :