এদেশে প্রফেশনাল ডিপ্লোমা সেক্টরে সংস্কার প্রয়োজন, এগুলো মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে! M. Mijanur M. Mijanur Rahman প্রকাশিত: ১০:৩৪ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৭, ২০২০ বাংলাদেশে প্রায় সকল প্রফেশনাল ডিপ্লোমা সেক্টরে অরাজকতা চলছে! সেটা হোক মেডিকেল রিলেটেড ডিপ্লোমা কিংবা টেকনিক্যাল-ভোকেশনাল রিলেটেড ডিপ্লোমা। এখন আর কোনো প্রফেশনাল ডিপ্লোমাকেই এদেশে মূল্যায়ন করা হয় না। বিদেশে প্রফেশনাল ডিপ্লোমাকে অনেকটা মূল্যায়ন এখনো করা হয়। ওখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা বা ডিগ্রির চেয়ে ব্যক্তির মেধা, মনন, জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতাকে মূল্যায়ন করে চাকরিতে পদোন্নতির ব্যবস্থা রাখা হয়। বিদেশে কর্মক্ষেত্রে একজন ডিপ্লোমাধারীও, স্নাতকধারীর সমান পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। আলোচনার এ পর্যায়ে এসে আপনাদের জানানোর চেষ্টা করব এদেশে ডিপ্লোমা গ্র্যাজুয়েশনে কোন ক্যাটাগরির শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। প্রথমত; সরকারি ডিপ্লোমা প্রতিষ্ঠানে গরিব, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মেধাবী সন্তানরা ভর্তি হয়। কারণ তাদের কাছে কলেজ, ভার্সিটি পড়ার মত যথেষ্ট টাকা ও সময় থাকে না। দ্বিতীয়ত; এসএসসি পাশ মেধাবী পনের-ষোল বছরের স্রেফ নাবালক অনেকেই ডিপ্লোমা গ্র্যাজুয়েশন সম্পর্কে না জেনে বোঝেই পরিবারের সিদ্ধান্তে এখানে ভর্তি হয়। তৃতীয়ত; বেসরকারি ডিপ্লোমা প্রতিষ্ঠানে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী ছেলে-মেয়েরা ভর্তি হয় বলে জনশ্রুতি আছে। এবিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। এবার দেশের বাইরের ডিপ্লোমাধারীদের চিত্রে আসি। বিদেশে প্রায় সকল ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীরা পরবর্তীতে স্নাতক ডিগ্রি, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, ডক্টরেট ডিগ্রি, পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রি করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশে কিছু ডিপ্লোমাধারীর জন্য স্ব স্ব উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকলেও বেশির ভাগ ডিপ্লোমাধারীর সে সুযোগ নেই। যেমন; বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের ৪ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ফ্যাকাল্টি ডিএমএফ ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীরা বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বিএমডিসি নিবন্ধিত হওয়ার পরও এসকল ডিপ্লোমা চিকিৎসকদের উক্ত কাউন্সিল স্বীকৃত অধিকতর স্নাতক উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেই! বাংলাদেশে এমনও লক্ষ লক্ষ ডিপ্লোমাধারী পেশাজীবী রয়েছেন যারা সরকারি চাকরির শুরুতে যে গ্রেডে বেতন-ভাতা পেতেন, ৪০ বছর চাকরি করার পরও সেই একই পদ-গ্রেডে বেতন-ভাতা পান, একই চেয়ারে আছেন। চাকরিকালীন সময় সন্তুোষজনক হওয়ার পরও এদের কোনো পদোন্নতি নেই! অপরপক্ষে, স্নাতক ডিগ্রি সমমান ধারীরা সরকারি চাকরিতে এন্ট্রি পদে ৯ম গ্রেডে যোগদান করে পদোন্নতি পেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে গ্রেড ১ম হয়ে যান! আবার তারও উপর সুপার গ্রেডে যান! তাহলে কেন একজন ডিপ্লোমা করে চাকরি ক্ষেত্রে এই আজন্ম বৈষম্যের শিকার হবেন? বাংলাদেশে ৪ বছরের ডিপ্লোমাধারীরা বেশির ভাগই এন্ট্রিপদে গ্রেড ১২তম থেকে গ্রেড ১০ম এর মধ্যে যোগদান করেন। ৭৫% ডিপ্লোমাধারীর চাকরি ব্লক পোস্ট, অর্থ্যাত সারাজীবন চাকরি করবেন তবুও কোনো পদোন্নতি পাবেন না! এ যেন প্রাগৈতিহাসিক ক্রীতদাস ব্যবস্থার চরম উৎকৃষ্ট উদাহরণ! সরকারি চাকরিতে প্রতিহাজার ডিপ্লোমাধারীর মধ্য থেকে কেবলমাত্র ২জন ডিপ্লোমাধারী সর্বোচ্চ ৫ম গ্রেডে ও ৪% ডিপ্লোমাধারী সর্বোচ্চ ৭ম গ্রেড সেইসাথে ৬% ডিপ্লোমাধারীর সর্বোচ্চ ৯ম গ্রেডে পদোন্নতিসহ পদ-পরিবর্তনের ব্যবস্থা রয়েছে! টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেডে বেতন ভাতা বাড়লেও পদ-পরিবর্তন ও সম্মান, মর্যাদা কোনটাই বাড়ে না। বিষয় টা যেই লাউ সেই কদুর মতো অবস্থা বলতে পারেন। এর বাইরে সকল ডিপ্লোমাধারী ৪০ বছর একই পদে, একই চেয়ারে থাকেন। অর্থ্যাত, এদের কোনও পদোন্নতি- পদপরিবর্তনের ব্যবস্থা নেই! খাঁটি বাংলায় যাকে বলে এসব ডিপ্লোমাধারী ব্যক্তির মেধা, মনন, জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতাকে মূল্যায়ন করা হয় না। যা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হরণের মধ্যে পড়ে। যে ডিপ্লোমা শিক্ষায় স্ব স্ব উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেই, ইন সার্ভিসে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেই, চাকরিতে পদোন্নতির ব্যবস্থা নেই সেই ডিপ্লোমা শিক্ষাকে মরণফাঁদ বললে আশাকরি কারো আপত্তি থাকবে না। আমার রিসার্চে এমনও বিষয় প্রতিয়মান হয়েছে, অফিসের এমএলএসএস-পিয়ন পদোন্নতি পেয়ে পেয়ে অফিসের বড় বাবু হয়েছেন, একাউন্টস্ অফিসার, এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, পারসোনাল অফিসার প্রভৃতি হয়েছেন, একই অফিসে ৪০ বছর সন্তোষজনক চাকরি করার পরও ডিপ্লোমাধারীদের পদোন্নতি হয় নি! এটা স্রেফ অন্যায় ও বেবিচার। আমার কাছে হাজার হাজার অভিযোগ রয়েছে চাকরি ক্ষেত্রে এদেশে প্রফেশনাল স্নাতক ডিগ্রিধারীরা, প্রফেশনাল ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের সাথে সতীনের মতো খারাপ ব্যবহার সহ অবজ্ঞা, অবহেলার চোখে দেখেন! অনেক প্রফেশনাল স্নাতকধারী মনে করেন, প্রফেশনাল ডিপ্লোমাধারীদের কেবল তাদের আরাম-আয়েশের জন্য ক্রীতদাস স্বরূপ নিয়োগ দেয়া হয়! ৫০% প্রফেশনাল স্নাতকধারী ইন সার্ভিসে সরকারি ভাবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করার সুযোগ পান। স্নাতকোত্তর অর্জন শেষে সবাই পদোন্নতি পান, তাদের অনেকেই গ্রেড ১ম, গ্রেড ২য় কিংবা সুপার গ্রেড প্রাপ্ত হন। কিছু ক্ষেত্রে গ্রেড ১ম, গ্রেড ২য় কিংবা সুপার গ্রেড পেতে স্নাতক ডিগ্রি সমমানই যথেষ্ট। আর মাত্র ১% এরও কম প্রফেশনাল ডিপ্লোমাধারীর ইন সার্ভিসে সরকারিভাবে প্রফেশনাল স্নাতক ডিগ্রি করার সুযোগ রয়েছে। স্নাতক ডিগ্রি, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন শেষে এদের মাত্র কয়েকজন কালেভদ্রে দু’একটা পদোন্নতি পান। তবে এদের কেউ এখন পর্যন্ত গ্রেড ৫ম অতিক্রম করতে পারেন নি। আবার কিছু ডিপ্লোমাধারী হাজার কষ্ট করে স্নাতক, স্নাতকোত্তর করলেও তাদেরকে পূর্বতন ডিপ্লোমা উপাধির তকমা সহ সিল ছাপ্পর লাগিয়ে দেয়া হয়। গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট উপাধিতে তারা পরিচিতি টুকুও পান না। অভিযোগ রয়েছে অনেক স্নাতক- স্নাতকোত্তর পেশাজীবী ডিপ্লোমাত্তর গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট পেশাজীবীদের হিংসে করেন! কোন স্নাতক-গ্র্যাজুয়েট সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি সংস্থায় কাজ করলে তাদের সেই কাজের অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতার বছর সমূহ নিজ কিংবা অন্য ডিপার্টমেন্টে অধিকতর উচ্চ পদে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে কাউন্ট করা হয়। এক্ষেত্রে যে কোন বয়সে কেউ একজন অধিকতর উচ্চ পদে নতুন নিয়োগ পেতে পারে। বাট কোন ডিপ্লোমাধারী সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি সংস্থায় বছরের পর বছর কাজ করলেও তাদের সেই কাজের অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতার বছর সমূহ নিজ কিংবা অন্য ডিপার্টমেন্টে অধিকতর উচ্চ পদে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে কাউন্ট করা হয় না। এ যেন আজন্ম ডিপ্লোমা ক্রীতদাস ব্যবস্থা ধরে রাখার প্রয়াস! এ বৈষম্যের শেষ কোথায়? তারপরও কেন, কেউ একজন মেডিকেল রিলেটেড- কারিগরি-ভোকেশনাল ডিপ্লোমা করবেন? গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট পেশাজীবীদের এটা মনে রাখতে হবে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ও একবিংশ শতাব্দীর শুরুর প্রথম দশকে তাঁরা ৩ বছরের স্নাতক অনার্স/ ডিগ্রি সমমান কোর্স সহ ১ বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সমমান মিলিয়ে সর্বোমোট যে ৪ বছর পড়তেন, এখনকার ডিপ্লোমাধারীরা ৪ বছর ডিপ্লোমা ডিগ্রিতে সমান ক্রেডিট আওয়ার ইন্সটিটিউটে পড়ে। একবিংশ শতাব্দীর বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ প্রফেশনাল ডিপ্লোমা ডিগ্রি কোর্স আর প্রফেশনাল স্নাতক অনার্স/ ডিগ্রি কোর্স ৪ বছর মেয়াদী। তারপরও কর্মক্ষেত্রে এতো বৈষম্য হবে কেন? এটা মেনে নেয়া যায় না। এমতাবস্থায় এদেশের ডিপ্লোমা সেক্টরে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। তা না হলে এখনকার যুগে স্রেফ ডিপ্লোমা করার মানে নিজেকে স্রেফ মার্ডার করা! এসব ডিপ্লোমা মরণফাঁদ পাতানোর বিরুদ্ধে প্রত্যেকের সোচ্চার হওয়া উচিত। কাজেই যতদিন পর্যন্ত ডিপ্লোমা সেক্টরে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার না হবে ততদিন পর্যন্ত এদেশের প্রেক্ষাপটে প্রফেশনাল ডিপ্লোমা ডিগ্রি কে না বলুন, আর প্রফেশনাল স্নাতক ডিগ্রি কে হ্যাঁ বলুন। বি. দ্র. উক্ত লেখনীতে সাধারণ শিক্ষায় স্নাতক, স্নাতকোত্তর কিংবা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রফেশনাল ডিপ্লোমার কথা আলোকপাত করা হয় নি। লেখক : ডা. এম. মিজানুর রহমান (জনস্বাস্থ্যবিদ) ডিপ্লোমা চিকিৎসক পেশাজীবী লিডার। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট জনস্বাস্থ্যবিদ পেশাজীবী লিডার। আইন শাস্ত্রের শিক্ষার্থী ও সুলেখক। আপনার মতামত দিন : SHARES অন্যান্য বিষয়: