করোনার বিরুদ্ধে লড়াই: ১৪ মাসের মেয়েটাকে দেখি না তিন সপ্তাহ ধরে Emon Emon Chowdhury প্রকাশিত: ৭:১১ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৫, ২০২০ ছবির সাদা ড্রেস পড়া কিম্ভূতকিমাকার লোকটা আমি। ড্রেসটার একটা গালভরা নাম আছে ‘পিপিই’। ড্রেসটা শোঅফ করার জন্য পড়া হয়নি৷ ছবিটাও যাকে বলে একদম ক্যানডিড! সারা বাংলাদেশে করোনা আতঙ্ক এখন প্রবল। তাই সন্দেহজনক যেকোনো মৃত্যুতে মেডিকেল টিমের অংশ হিসেবে ইনভেস্টিগেশনে যেতে হয়। আইইডিসিআরকে জানাতে হয়। প্রয়োজনে স্যাম্পল কালেকশন করতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে প্রশাসনের সহযোগিতায় লকডাউন করতে হয়। গত তিন-চারদিনের মধ্যে এটা আমার তৃতীয় ইনভেস্টিগেশন। পরের ছবিটা দুই দিন আগের। ৫০ বছরের এক চা শ্রমিক মারা গিয়েছেন। উনার বাসায় যাবার জন্য একদম ভোরে হাসপাতাল থেকে ২২-২৩ কিলো পাড়ি দিয়ে মোটামুটি ১৩০-১৪০ ফিট উঁচু একটা পাহাড় হেটে ডিংগোতে হয়েছে। তাও ভালো এইবার সাথে পিপিই ছিলো। আগের দুটো ডেথে পিপিই ব্যবহার করা যায়নি। কারণ তখনো পিপিই এসে পৌঁছেনি। ওই দুটো ডেথে নিজের প্রটেকশন বলতে ছিলো মাস্ক আর গ্লাভস। আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজে ২০০৯-১০ সেশনে ক্লাস শুরু করেছিলাম ১৮০ জন। ওই সেশনে সারা বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যাডমিশন টেস্টে প্রথম হয়েছিলাম। এরপর প্রতিটি পেশাগত পরীক্ষায় ৮০% এর উপরে নাম্বার পেয়েছি। কারিকুলামের ১১ বিষয়ের ৬টিতে বিশেষ সম্মাননা ছিলো। আমার ব্যাচের বন্ধুরা অনেকেই পাড়ি জমিয়েছে ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশে। কেউ ইংল্যান্ডের NHS এ ট্রেনিং পোস্টে, কয়েকজনের USA তে রেসিডেন্সিতে ম্যাচ হয়েছে, কেউ থিতু হয়েছে কানাডাতে। অহঙ্কার করার জন্য বলছি না। আমার ধারণা, চেষ্টা করলে পৃথিবীর যে কোনো দেশে নিজের জন্য একটা জায়গা ঠিকই করে নিতে পারতাম। শুধু আমি একা না, বাংলাদেশের সিংহভাগ ডাক্তারদেরই সেই সক্ষমতা আছে। কিন্তু মা আর মাটির মায়ায় দেশ ছাড়তে পারিনি! অবশেষে সরকারি চাকুরিতে জয়েন করলাম গত ডিসেম্বরে। করোনা ক্রাইসিসে দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে পিপিই ছাড়াই এতোদিন আউটডোরে রোগী দেখেছি, ইনডোর ইমারজেন্সি সামলেছি। আমি একা না। আমার সাথের শ্রীমঙ্গল হাসপাতালের বাকি সব কলিগও তাই করেছেন। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া সারা বাংলাদেশের চিত্র একই। যে কোন সময় নিজেই করোনা আক্রান্ত হতে পারি। কপালে থাকলে মারাও যেতে পারি। বাংলাদেশের কয়েকজন ডাক্তার, সেবিকা ইতিমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন। শুধুমাত্র করোনা ক্রাইসিস নয়, গত বছর ডেঙ্গুর সময়ও ডাক্তাররা ঝুঁকি নিয়ে সাধ্যের অতিরিক্ত করেছেন। জীবন দিয়েছেন। এর বিনিময়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো রিকগনিশন জোটেনি। বরঞ্চ ডাক্তারদের রিকগনিশনের প্রশ্নে সেদিন একাত্তর টিভির এক প্রেজেন্টারতো বলেই বসলেন সুইপাররাও তো কোনো প্রটেকশন ছাড়াই কাজ করেন! তাদেরও তো রিকগনিশন নেই! ব্যারিস্টার সুমনকেও দেখলাম লাইভে বলছেন ডাক্তাররা নাকি চিকিৎসা ছেড়ে পালাচ্ছেন! শুধু তারা নন, বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষের ধারণাতেই ডাক্তাররা ভিলেন, ডাক্তাররা কসাই! অথচ সারা বাংলাদেশের প্রত্যেকটা সরকারি হাসপাতালের জরুরি এবং বহিঃবিভাগ খোলা। হ্যা, এটা ঠিক ব্যক্তিগত চেম্বার বন্ধ। কারণটাও তো সহজেই অনুমেয়। চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বারে একজনও যদি করোনাক্রান্ত রোগী আসে এবং তার দ্বারা যদি কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ত্বরান্বিত হয় তার দায় কে নেবে! তারপরও রোগীর প্রয়োজনে এই ডাক্তাররাই ব্যক্তিগত চেম্বারের বদলে টেলিমেডিসিন সেবা দিচ্ছেন ফ্রিতে। আমার সেকেন্ড বয় বন্ধু Ferdous Ahmed Raffi NHS এ জব করে। ও প্রায়ই পোস্ট দিচ্ছে ওখানকার জনগণ কিভাবে ডাক্তারদের সম্মানিত করছে। বাসায় এসে বাজার দিয়ে যাচ্ছে। উবার ফ্রি রাইড দিচ্ছে। বিভিন্ন চেইন ফুডশপগুলোতে হাসপাতালে ফ্রিতে ফুড ডেলিভারি দিচ্ছে। দিল্লিতে হেলথকেয়ার প্রোভাইডারদের জন্য এক কোটি রুপির বিমা করা হয়েছে। আর আমার এখানে আমাকে এই ক্রাইসিসে হাজার টাকার মোটরের কাজ দুইহাজারে করাতে হচ্ছে। ৩০ টাকার রিকশাভাড়া ৫০ টাকা হয়েছে। পিপিই এর বদলে রেইন কোট কিনতে গিয়ে ৪০০ টাকার রেইনকোট ৬০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ২ টাকা পিস সারজিকাল মাস্ক ৩০-৪০ টাকা পিস হয়েছে। সাথে ফেসবুকে ঢুকলে ফ্রিতে গালিতো আছে। আমার ১৪ মাস বয়সের মেয়েটার কাছে আমি যাচ্ছি না গত তিনসপ্তাহ। প্রায় ষাট বছর বয়সী ডায়াবেটিক বাবাকেও ভিডিও কলে বারবার বলছি বাসা থেকে খবরদার বের হবে না। মা এর সাথে কবে সামনাসামনি দেখা হবে বা আর দেখা হবে কিনা তাও জানি না। কারণ উনাদের ওখানে গেলে কে জানে হয়তো নিজের অজান্তেই ভাইরাসের বীজ উনাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে আসবো! আমাদেরতো এখন ভাইরাসের মধ্যেই বসবাস! তাই আমাদের এই স্বেচ্ছা নির্বাসন। অথচ যেখানে আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর কেউ নেই সেই শ্রীমঙ্গলে কারো ১৪ মাসের বাচ্চার খিচুনি থামাচ্ছি, কারো ষাটোর্ধ ডায়াবেটিক বাবার ইনসুলিনের ডোজটা ঠিক করে দিচ্ছি, কারো মায়ের হুটহাট বুকে ব্যাথার কারণ খুজে বেড়াচ্ছি। শুধু ডাক্তাররা নন, হাসপাতালের প্রতিটি স্টাফ এমনকি ক্লিনার দিলীপ পর্যন্ত বুকে ব্যথা নিয়েও সকালে আর বিকেলে ঘাড়ে ১৪ লিটারের স্প্রেয়িং মেশিন নিয়ে হাসপাতালের আনাচে কানাচে ক্লোরিন সলিউশন ছিটিয়ে বেড়াচ্ছে শুধু আপনি আর আপনারা ভালো থাকবেন এই সময়ে এই আশায়। এর বিনিময়ে ফ্রি উবার রাইড, ফ্রি বাজার, বাড়ি ভাড়া মওকুফ, কোটি টাকার ঝুঁকি ভাতা কিংবা হাত তালি, প্রশংসাও চাচ্ছি না। শুধু ফেইসবুকে বসে আপনাদের ডালগোনা কফি হাতে কোয়ারান্টাইনের দিনগুলোতে আমাদের স্যাক্রিফাইসগুলোকে খাটো করবেন না। কারণ তখনই মনোবল হারিয়ে ফেলি। মনে হয় এদের জন্য এসব করছি! আমি এতো বোকা কেনো? আমরা এতো বোকা কেন? ডা. মুহম্মদ আবু নাহিদ মেডিকেল অফিসার, শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। রেসিডেন্ট, ইউরোলজি (ফেজ-এ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০৯-১০ সেশনে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় জাতীয় মেধায় প্রথম আপনার মতামত দিন : SHARES চিকিৎসক কলাম বিষয়: