করোনাভাইরাস: সকল চিকিৎসক জীবন দিলেও দোষারোপের ধারা বন্ধ হবে না

Emon Emon

Chowdhury

প্রকাশিত: ১০:৩৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৬, ২০২০

আজকে বউয়ের হোম কোয়ারেন্টাইনের ৪র্থ দিন। বেড রুমের দরজার সামনে যেই চেয়ার দেখা যাচ্ছে প্রতিবেলায় সেই চেয়ারে খাবার রেখে আসি আর বউ এসে রুমে নিয়ে যায়। আমি থাকি পাশে গেস্ট রুমে। গত ১ এপ্রিল সাসপেক্টেড কোভিড রোগীর কন্টাক্টে আসার পর থেকে এভাবেই চলছে আমাদের সংসার।

ওই দিন রাত ১২টায় বউ যখন হাসপাতাল থেকে ফোনে জানালো সারাদিনই একটা সাসপেক্টেড রোগীর এক্সপোজারে থাকায় কাল (পরদিন) থেকে তাকে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে তখন আমি অন্য হাসপাতালে ডিউটিরত।

এতো রাতে ডিউটি ছেড়ে বাসায় নিয়ে আসার ব্যবস্থাও নেই। দুইজনেরই ২৪ ঘণ্টা ডিউটি শেষ হবে সকালে। এ অবস্থায় সারা রাত কিভাবে কেটেছে আল্লাহ ভালো জানেন।

সকালে বাসায় ফোন দিয়ে আম্মাকে আগে ভাইয়ার বাসায় পাঠালাম। বয়স্ক মানুষদের ঝুঁকি বেশি তাই আগেই সাবধানতা অবলম্বন করলাম। বউকে গাউন, মাস্ক, গগলস পরিয়ে বাসায় এনেই পাঠিয়ে দিলাম বেড রুমে।

আমার ২ সপ্তাহের জামা-কাপড় আর কিছু জরুরি জিনিস নিয়ে চলে আসলাম গেস্ট রুমে।

তারপর থেকে চলছে আমাদের হোম কোয়ারেন্টাইনের দিনগুলো। লকডাউনে অনেকে হ্যাশট্যাগ স্টে হোম স্টাটাস দিচ্ছে আর আমরা নিরুপায় হয়ে বাসায় বন্দি।

সকাল-বিকাল বউয়ের জন্য আনাড়ি হাতে এটা ওটা বানিয়ে খুশি রাখার চেষ্টা করি। দুপুর আর রাতের খাবার চারতলায় ভাইয়ার বাসা থেকে মান্না সালওয়ার মতো নাজিল হয় আলহামদুলিল্লাহ।

ডাইনিং আর বেড রুমের দুই মাথায় দুইটা সোফা রেখেছি। প্রায় ২০ ফুট দূর থেকে কখনো জোরে, কখনো ইশারায় কথা বলি। দুইজন বইয়ের স্তুপ নিয়ে বসেছি, বই পড়ি, বই এর কথা আদান প্রদান করি।

গুড নাইট বলে পাশের রুমে ঘুমাতে যাই। কিন্তু অজানা আতঙ্ক কখনো পিছু ছাড়ে না। প্রতিরাতে মনে হয় কাল সকালে উঠে ওকে সুস্থ অবস্থায় পাবো তো? সকালে উঠে যদি দেখি জ্বর, কাশি নেই মনে হয় আজ আবার নতুন জীবন ফিরে পেলাম।

এভাবেই কেটে যাক আরো কয়েকটা সকাল। তারপর যেন মুক্তি মিলে এই যন্ত্রণাময় দিনগুলোর। দেখি, শুনি, বলি কিন্তু ছুঁতে পারি না। এই কষ্ট বোঝানো অসম্ভব।

নিজের হাসপাতালের ৭ জন ডাক্তারকে গত মাসে বিভিন্ন সময়ে কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়েছি। তখন শুধু ফোনে তাদের কষ্টের কথা শুনতাম। কিন্তু এখন নিজেরাই সেই যন্ত্রণার সাক্ষী।

যে জায়গায় এখন ইউরোপ আমেরিকা পৌঁছেছে আমরা সেই পথে সবে যাত্রা শুরু করলাম। অনেক ডাক্তার আগামী দিনে এই যুদ্ধে নিজেদের বিলিয়ে দিবে। তাতেও হয়তো মানুষের এই সব ডাক্তারদের দোষ দেওয়ার ধারা থেমে থাকবে না। হয়তো এই জনপদে এক সময় দোষারূপ করার জন্যও কোনো ডাক্তার খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবুও আমরা স্বপ্ন দেখি আল্লাহ আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকাবেন। কারণ এক আল্লাহ ছাড়া কোনো ডাক্তার, সরকার, শিল্পপতি এই মহামারী আটকাতে পারবে না।

যদি আপনজনকে ভালোবাসেন, তাহলে কিচ্ছু করতে হবে না। একটাই অনুরোধ, বাসায় থাকুন। এমন এক রোগ! ভালোবাসার মানুষটাকে আপনিই ছুঁতে যাবেন না। দূর থেকে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই।

দোয়া করবেন যেন বাকি দিনগুলো সুস্থভাবে কাটিয়ে দিতে পারি। আম্মা তার বিছানা ছাড়া রাতে ভালোভাবে ঘুমাতে পারেন না। আরো কয়েকটা সকাল দ্রুত কেটে যাক যেন আম্মা তার বিছানায় আবারো নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারে।

ডা. আলী হোসাইন মাহীদ

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

আপনার মতামত দিন :