করোনা: মৃত্যু হার কমানোর চেয়ে প্রতিরোধ অনেক সহজ Emon Emon Chowdhury প্রকাশিত: ১০:৩৭ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৬, ২০২০ করোনা আক্রান্ত ৮০-৮১ ভাগ রোগী চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যায়। ২০ ভাগ রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। এর মধ্যে ১৪ ভাগ রোগী সিভিয়ার নিউমোনিয়ায় ভোগে এবং তাদেরকে অবশ্যই অক্সিজেন সাপ্লাই দিতে হয়। বাকি ৫ ভাগ রোগীর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) সাপোর্ট লাগে। এই ৫ ভাগ রোগীর বেশিরভাগ একিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোমে (আরডিএস) চলে যায়। এসব রোগীদের আইসিইউ সাপোর্ট ছাড়া বাঁচানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর আইসিইউ সাপোর্ট পাওয়ার পরেও এআরডিএস রোগীদের মৃত্যুহার ৩০-৫০ ভাগ। আর সিভিয়ার নিউমোনিয়ার রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার পরেও মৃত্যুহার ২০ ভাগ। এটি একটি জটিল হিসাব গাণিতিকভাবে হিসাব দিয়েই বলি। মনে করি, বাংলাদেশে ১০০ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এই ১০০ জনের মধ্যে ৮০ জন রোগীর হাসপাতালে চিকিৎসা দরকার পড়বে না। এই ৮০ জন মাইল্ড বা মডারেট কোভিড-১৯ রোগে ভুগবেন। তাদের হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন নাও হতে পারে। বাকি ২০ জন রোগীর মধ্যে ১৪ জন সিভিয়ার নিউমোনিয়ায় ভুগতে পারেন, তাদের চিকিৎসা দেওয়ার পরেও যেহেতু মৃত্যুহার ২০ ভাগ। ১৪ জনের ২০ ভাগ হলো ২.৮ জন। ২.৮ জন রোগী চিকিৎসা পেয়েও মৃত্যুবরণ করতে পারেন। আর ১০০ জনে ৫ জন আরডিএসে চলে যায়। এদের মধ্যে ভেন্টিলেটর সাপোর্ট না পেলে ৫ জনই মারা যাবে। সাপোর্ট পেলেও মারা যাওয়ার আশঙ্কা আছে ৩০-৫০ ভাগের। সংখ্যায় যা ১.৫ জন থেকে ২.৫ জন। সব ক্রিটিক্যাল রোগীকে আইসিইউ সাপোর্ট দেওয়া সম্ভব হলেও মৃত্যুর হার ৪.৩ ভাগ। আইসিইউ সাপোর্ট দেওয়া সম্ভব না হলে এই মৃত্যুর হার গিয়ে দাঁড়াবে ৭.৮ ভাগে। এতএব করোনা রোগের মৃত্যুর হার নির্ভর করে একটি দেশের হেলথ ফেসিলিটি কি পরিমাণ আছে এবং কি পরিমাণ আক্রান্ত হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে। এবার আসি সারা বিশ্বে কোন দেশে কিরকম আইসিইউ সাপোর্ট আছে, কি পরিমাণ হেলথ ফেসিলিটি আছে। কোন দেশের আইসিইউ সাপোর্ট কেমন আছে সেটা নির্ভর করে সেই দেশের প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য কয়টি আইসিইউ বেড বরাদ্দ আছে তার উপর। সবচেয়ে ভাল আইসিইউ সাপোর্ট আছে আমেরিকার। প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য আইসিইউ বেড আছে ৩০টি। ইটালিতে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য আইসিইউ বেড আছে ১২টি। স্পেনে আছে ৮.৩টি, ইন্ডিয়াতে ২.৩টি। বাংলাদেশে প্রতি লক্ষ মানুষের জন্য আইসিইউ বেড আছে ০.৭টি। মানে প্রতি ১লাখ মানুষের জন্যেও একটি আইসিইউ বেড নাই আমাদের। তাহলে আমাদের দেশে আমেরিকার মত মহামারী শুরু হয়ে গেলে আমরা কিভাবে মৃত্যুহার কমাবো? চেয়ে চেয়ে মৃত্যু দেখা ছাড়া কিছু করার থাকবে না। স্পেন, ইটালি, ফ্রান্সে কেন এত সারি সারি লাশ, তা হিসাব করলেই বোঝা যাবে। স্পেনে জনসংখ্যা মোট ৪৬,৭৫৪,৭৭৮ জন। তাদের প্রতি এক লক্ষ মানুষের জন্য আইসিইউ বেড আছে ৮.৩ টি। তাহলে গাণিতিক হিসাবে মোট আইসিইউ বেড আছে ৩ হাজার ৮৮০টি। স্পেনে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১১৭,৭৭০ জন। এর ৫ ভাগ রোগীর যদি আইসিইউ সাপোর্ট লাগে তাহলে আইসিইউ বেডের প্রয়োজন ৫ হাজার ৮৮৮টি, যা তাদের মোট আইসিইউ বেডের চেয়ে ২ হাজার আটটি বেশি। তাছাড়া সিভিয়ার নিউমোনিয়ার কিছু রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট লাগতে পারে। একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায়, আরও অনেকদিন আগে থেকেই তারা তাদের ক্রিটিক্যাল রোগীদের চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। শুধু চেয়ে চেয়ে মৃত্যু দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারছে না । লাশের পর লাশের মিছিল। কিন্তু স্বজনদের আহাজারি নাই, নাই কোনো কোলাহল। নিরবে-নিভৃতে স্বজনদের কান্না আর লাশের গন্ধে ইউরোপের বাতাস ভারি হয়ে যাচ্ছে। দেখার কেউ নাই, সমবেদনা প্রকাশ করার কেউ নাই। এবার আসি আমাদের বাংলাদেশের হিসাব নিয়ে। বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলে মোট আইসিইউ বেড ১ হাজার ১৭৪টি। বেশিরভাগ প্রাইভেট হাসপাতাল করোনা রোগীদের চিকিৎসায় আগ্রহ প্রকাশ করছে না। তাছাড়া অন্যান্য রোগী ভর্তি থাকায় বেশিরভাগ আইসিইউ বেড অলরেডি অকোপাইড। যেই আইসিইউতে করোনা রোগী থাকবে, সেখানে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। সেটা করলে অন্যান্য সব রোগীদের কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। এভাবে হিসাব করলে বাংলাদেশে মোট করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য আইসিইউ বেড বরাদ্দ আছে মোট ২৫০টি। ঐকিক নিয়মে অংক করলে পাওয়া যায়, বাংলাদেশে যদি ৫ হাজার মানুষ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয় তাহলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী ৫ ভাগ মানুষের আইসিইউ সাপোর্ট লাগলে ২৫০টি আইসিইউ বেড ফিল আপ হয়ে যাবে। আর যদি বাংলাদেশের সব আইসিইউ করোনা রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা হয় তাহলেও ২৩ হাজার করোনা আক্রান্ত হলেই আর কোনো আইসিইউ বেড ফাঁকা থাকবে না। তখন শুধু উপরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মৃত্যু দেখতে হবে। কারোই কিছু করার কিছুই থাকবে না। এই কথাগুলো সবই বৈজ্ঞানিক এবং গাণিতিক হিসাব। কিন্তু কোভিড-১৯ কোন গাণিতিক নিয়ম মানে না, মানে না কোনো অংকের হিসাব। ডব্লিউএইচও এর গাণিতিক হিসাবের চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ এই কোভিড-১৯, যা যুক্তরাষ্ট্র, ফান্স আর ইতালিকে দেখলেই অনুমান করা যায়। তাই আসুন সচেতনতা বাড়াই, প্রতিরোধ করি। ডা. কাওসার আলম মেডিকেল অফিসার ও রেসিডেন্ট, কার্ডিওলজি বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আপনার মতামত দিন : SHARES চিকিৎসক কলাম বিষয়: