নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত করোনা ইউনিটের চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা

Emon Emon

Chowdhury

প্রকাশিত: ১১:২৮ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৮, ২০২০

মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ লাখ ছাড়িয়েছে। বিশ্বের এ ভয়াবহ সংকটে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছেন। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছে কয়েক হাজার চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী। এরই মধ্যে মারা গেছেন অনেকে।

এদিকে দেশেও ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে মহামারি করোনাভাইরাস। আক্রান্ত হয়েছে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্স। এ ভাইরাস প্রতিরোধে সরকার ইতিমধ্যে নানান কর্মসূচী হাতে নিলেও কিছু সমন্বয়হীনতা রয়েছে। তাই সরকারের নেয়া এসব পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে করোনা প্রতিরোধ বহুলাংশে সহজ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

দায়িত্ব পালনের সময় স্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার ও সুরক্ষিত আবাসন ব্যবস্থা না থাকা, স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত না করতে পারা, আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর পরিচালনায় অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট করোনা মোকাবেলায় অন্তরায়। ৮ এপ্রিল (বুধবার) চিকিৎসক, নার্স ও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণী স্বাস্থ্যকর্মীদের সাথে কথা বললে তারা মেডিভয়েসকে এসব সমস্যার কথা জানায়।

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের করোনা ইউনিটের আইসিইউতে দায়িত্বরত সিনিয়র স্টার্ফ নার্স খাদিজা খাতুন বলেন, সেবাই আমাদের ব্রত। আমরা সেবা দিতে চাই।  কিন্তু সবার আগে তো আমাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তারপরেই তো সেবা। আমরা অসুস্থ হয়ে গেলে সেবা দিবে কে? তাই দ্রুতই সুরক্ষিত পরিবেশে খাবার ও অবাসন ব্যবস্থা করতে হবে। নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে নতুন নার্স নিয়োগ দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ নার্সেস এসোসিয়েশন ঢামেকের সাধারণ সম্পাদক মো. আসাদুজ্জামান জুয়েল। বর্তমানে তিনি ঢামেকের আইসোলেশন ইউনিটে নার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জুয়েল বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত এন ৯৫ মাস্ক ছাড়াই আইসোলেশন ইউনিটে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আজ পর্যন্ত ৫ জনের শরীরে করোনা সনাক্ত হয়েছে। কিন্তু আক্রান্ত এসব রোগীদের আমরা মাস্ক ছাড়াই সেবা দিয়েছি। ফলে আমিসহ আমাদের সহকর্মী সবাই বেশ আতঙ্কিত। পরিচালক স্যার খুবই আন্তরিক, কিন্তু মাস্ক সংকট থাকায় কর্তৃপক্ষ  সরবরাহ করতে পারছে না।

জুয়েল আরো বলেন, আমাদের সুরক্ষা সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে, তবে তা যথেষ্ট না। তাছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঠিক নিয়ম অনুযায়ী আইসোলেশনের বিধি-নিষেধ মানা হচ্ছে না। তাই আমরা নিজেদের কোনভাবেই সুরক্ষিত মনে করছি না।

এ ব্যাপারে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের করোনা ইউনিটে সেবা দেওয়া এক নার্স নাম প্রকাশের শর্তে বলেন, ডিউটি করে এসে রুম শেয়ার করে থাকতে হয়। এতে ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। ঝুঁকির মধ্যেও আমরা সেবা দিয়ে যাচ্ছি । কিন্তু তা কতদিন সম্ভব হবে, তা আমরা জানিনা।

বাংলাদেশ স্বাস্থ্য বিভাগীয় তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণি সরকারি কর্মচারী সমিতির সভাপতি ও ঢামেক সভাপতি মোঃ আবু সাইদ মিয়া  বলেন, আমাদের অনেকেই প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম পাচ্ছে না। দেশে বিভিন্ন হাসপাতালে আমাদের সহকর্মীরা অবহেলিত। সুরক্ষা সরঞ্জাম সবাইর জন্যই জরুরি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ট্রলি সরাসরি বহন করে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। ট্রলিতে উঠানো এবং ট্রলি থেকে নামানোর কাজটা তারাই করেন। এমনকি মৃত্যুর পর আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ তারাই বহন করেন। ফলে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর স্বাস্থ্যকর্মীদেরও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ নার্সেস এসোসিয়েশনে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সেবা মহাবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ইসমত আরা পারভীন বলেন, নার্সরা সেবা দিতে প্রস্তুত। আমার কাছে খবর এসেছে করোনা ইউনিটে দায়িত্বরত নার্সরা নিরাপদ খাবার ও আবাসন সুবিধা পাচ্ছে না। এসব সুবিধা পিপিই’র মতোই গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে সেবা দিবে কে। আমাদের নার্সরা দেশের সেবায় কাজ করতে চায়, তারা শুধু তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা চায়। তাই যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আমার অনুরোধ দেশের স্বার্থে সবার আগে স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করুন।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রফেসর আব্দুল্লাহ আল কাফী বলেন, এখন পর্যন্ত সুরক্ষা সরঞ্জামের কোন ঘাটতি নেই। তবে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর, আইসিইউ সুবিধাও বৃদ্ধি করতে হবে। অন্য বিভাগগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক থাকলেও আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর পরিচালনায় অভিজ্ঞ চিকিৎসকের কিছুটা সংকট রয়েছে। চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সরঞ্জাম নিশ্চিতের পাশাপাশি সুরক্ষিত পরিবেশে খাবার ও আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কাজ করছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী যাদের পিপিই  প্রয়োজন তাদের সবাইকে ইতিমধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে। তাছাড়া হাসপাতালের সব কর্মকর্তা- কর্মচারীদের যাতায়াতের জন্য ৬টি বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, যেসব চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিচ্ছেন, তাই তাদের শতভাগ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি। যেহেতু তারা করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেওয়ার পর বাসায় ফিরে যাচ্ছেন, ফলে তাদের পরিবারে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে। তাই এসব চিকিৎসক, নার্স তথা স্বাস্থ্যকর্মীদের হাসপাতলের মধ্যেই সুরক্ষিত পরিবেশে খাবার ও আবাসন ব্যবস্থা করার জন্য চেষ্টা করছি। বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গেলে সব স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ সুরক্ষায় রাখতে হবে। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এ সংকটে তারাই জাতির বীর যোদ্ধা।

সচেতনতা বাড়াতে হবে প্রত্যেক মানুষকে। জনসমাগমস্থল এড়িয়ে চলতে প্রচারণা চালাতে হবে। আর ঘরে থাকাটা এ মুহুর্তে নিরাপদ। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতাও করোনা ভাইরাসের আক্রমন থেকে রক্ষার একটা উপায়। এসব পদক্ষেপের পাশাপাশি অন্য আরো পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে নিলে করোনার থাবা থেকে অনেকটা মুক্ত হওয়া যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সেবা দিতে  প্রস্তুত করা হয়েছে, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল ও সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। এছাড়া ভাইরাস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে জেলা/উপজেলা পর্যায়ে মাল্টিসেক্টরাল কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি জেলা সদর ও উপজেলা পর্যায়ে এক বা একাধিক সুবিধাজনক স্থানে যেমন- স্কুল, কলেজ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আপনার মতামত দিন :