ডিপ্লোমা চিকিৎসক, গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসকের সংজ্ঞা জেনে নিন

প্রকাশিত: ৮:৪৩ অপরাহ্ণ, মে ৪, ২০২০

 

চিকিৎসক ও ডাক্তার এ দু’টি শব্দই বিশেষ্য পদ। সেইসাথে সমার্থক শব্দ। স্থান-কাল-পাত্রভেদে চিকিৎসক ও ডাক্তার শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বাংলা ভাষাভাষীর লোক চিকিৎসকদের ‘ডাক্তার’ বলে সম্বোধন করেন।

ব্যাচেলর ইংলিশ শব্দের বাংলা অর্থ হলো স্নাতক। ব্যাচেলর ইংলিশ শব্দের সিননিম-সমার্থক ইংলিশ শব্দ হচ্ছে গ্র্যাজুয়েট। এজন্যই স্নাতক পাশকৃতদের সারাবিশ্বে গ্র্যাজুয়েট বা গ্র্যাজুয়েটধারী বলা হয়। এজন্য নাতো কোন অতিরিক্ত আইন দরকার হয় নতো গেজেট, প্রজ্ঞাপন। বিশ্বাস না হলে দেখেন এ বিষয়ে কোন আইন, গেজেট, প্রজ্ঞাপন আছে কিনা। নেই।

এমতাবস্থায় যারা আন্ডার গ্র্যাজুয়েট (ডিপ্লোমা কোর্স) পাশ করেন তাদের মাপকাঠি হচ্ছে ডিপ্লোমাধারী। ডিপ্লোমা যদি কৃষিতে হয় তাহলে তাদের ডিপ্লোমা কৃষিবিদ বলা যাবে। আবার ইঞ্জিনিয়ারিং , নার্সিং, ফার্মেসী প্রভৃতিতে হলেও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, ডিপ্লোমা নার্স, ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট প্রভৃতি বলা যাবে। এজন্য অতিরিক্ত কোন আইন, গেজেট, প্রজ্ঞাপনের দরকার হয় না। এটাই সারাবিশ্বে স্বীকৃত নিয়মে পরিণত হয়েছে।

আমাদের দেশে অনেক ধরনের ডিপ্লোমাধারী পেশাজীবী রয়েছেন, রয়েছেন হোমিও, ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসকগণও। এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা বিদ্যায় ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ফ্যাকাল্টি ডি.এম.এফ ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীরা যেহেতু লাইসেন্সধারী ডিপ্লোমা হোল্ডার আর তাই ডিপ্লোমা মেডিকেল প্র্যাকটিশনার হিসেবে ডিপ্লোমা চিকিৎসক-ডিপ্লোমা ডাক্তার পরিচয় দিতে তাদের আইনানুগ কোন জটিলতা নেই। ডি.এম.এফ ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের একাডেমিক সনদে শিক্ষাগত যোগ্যতার মান নির্দেশক (ডিপ্লোমা) কথাটি উল্লেখ রয়েছে আবার বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল কর্তৃক প্রদত্ত পেশাগত নিবন্ধন সনদেও প্র্যাকটিশনার-পেশাদার হিসেবে (ডিপ্লোমা) মান নির্দেশক বা ক্যাটাগরি রয়েছে। আর এজন্যই ডি.এম.এফ ধারীরা ডিপ্লোমা চিকিৎসক-ডিপ্লোমা ডাক্তার। একাডেমিক সনদ ও পেশাগত নিবন্ধন সনদই এখানে গেজেট বলে বিবেচিত হবে।

এবার আসি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কি। ইংলিশ মাস্টার্স শব্দের বাংলা অর্থ স্নাতকোত্তর। আবার একই সাথে মাস্টার্স এর সিননিম ইংলিশ শব্দ হচ্ছে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট। একারণেই মাস্টার্স ডিগ্রি সমমান ধারীদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বলা হয়।

যারা চিকিৎসা বিদ্যায় মাস্টার্স ডিগ্রি বা সমমান ডিগ্রি অর্জন করবেন তারা যেমন নিঃসন্দেহে পোস্ট গ্র্যাজুয়েটধারী চিকিৎসক, তেমনি যারা ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করবেন তারা গ্র্যাজুয়েটধারী চিকিৎসক। ঠিক তেমনি যারা চিকিৎসা বিদ্যায় ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করবেন তারা ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসক।
আবার ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসকদের যেমন ডিপ্লোমা চিকিৎসক বলা যাবে তেমনি গ্র্যাজুয়েটধারী চিকিৎসকদের গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক, পোস্ট গ্র্যাজুয়েটধারী চিকিৎসকদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক বলা যাবে এজন্যও অতিরিক্ত কোন আইন, গেজেট বা প্রজ্ঞাপন দরকার নেই। বিষয়টি এমন নয় যে আপনি ব্যাচেলর ডিগ্রি করেই পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বনে যাবেন। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্স যেহেতু কোন বিষয়ে স্পেশ্যালাইজেশন কোর্স তাই তারা কোর্স শেষে নির্দিষ্ট বিষয়ের স্পেশ্যালিস্ট বা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পরিচয় দিয়ে থাকেন। এখন গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসকগণ যেহেতু (ডাক্তার) পরিচয় দেন, তাই তারা চাইবেন না ডিপ্লোমাধারীরা সরাসরি ডাক্তার পরিচয় দিক। এক্ষেত্রে চিকিৎসা বিদ্যায় ডিপ্লোমাধারীদের (ডিপ্লোমা ডাক্তার) পরিচয় দেয়া অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলে মনে করি। সেটা হোমিওপ্যাথিক, ইউনানী, আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রের ডিপ্লোমাধারীদের জন্যও প্রযোজ্য হতে হবে। তবে হ্যাঁ সকল (ডিপ্লোমা ডাক্তারদের) গ্র্যাজুয়েশন-স্নাতক করার সুযোগ দিতে হবে যাতে অধিকতর পড়াশোনা করে তারা (ডাক্তার) হতে পারেন। অন্যথায় উপরোক্ত আইডিয়া বলবৎ করা সম্ভব হবে না।

অনেক গ্র্যাজুয়েট ডাক্তার বলে থাকেন (ডিপ্লোমা ডাক্তার) বলে কোন টার্ম নেই। আসলে এদেশে ডিপ্লোমা, গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট সকল চিকিৎসকই (ডাক্তার) পরিচয় দেন। একারণে যেমন ডিপ্লোমা ডাক্তার টার্ম সুপ্রতিষ্ঠিত হয় নাই, তেমনি গ্র্যাজুয়েট ডাক্তার, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডাক্তার টার্মও সুপ্রতিষ্ঠিত হয় নি। এসকল কারণেই পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডাক্তাররা মনে করেন তারাই কেবল ডাক্তার অন্য কেউ ডাক্তার নয়, আবার গ্র্যাজুয়েট ডাক্তাররা মনে করেন ডিপ্লোমাধারীরা কেন ডাক্তার হবেন। এমতাবস্থায় ডিপ্লোমা ডাক্তার, গ্র্যাজুয়েট ডাক্তার, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডাক্তার টার্ম সুপ্রতিষ্ঠিত করে এসকল ব্লেম গেমস নির্মুল সম্ভব বলে মনে করি। কারণ চিকিৎসকতা পেশায় জেলাস ফিল করা বেমানান। আপনি যদি চিকিৎসক হয়ে আপনার নিচের ক্যাটাগরি চিকিৎসকদের প্রতি জেলাস ফিল করেন তাহলে আপনি মানুষকে কি সেবা দেবেন, রোগীকেই বা কি ফিল করবেন ?

সবশেষে দুটি কথা বলে আজকের নিবন্ধের ইতি টানব। প্রথম কথা ডিপ্লোমাধারীরা যদি ডিপ্লোমা চিকিৎসক নাই হতেন তবে এদেশে ৫৬ টি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ২৪ টি ইউনানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ২২ টি আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ২২০ টি মেডিকেল স্কুল (ম্যাটস্) সমূহে ডিপ্লোমা ইন হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন এন্ড সার্জারী ডিএইচএমএস, ডিপ্লোমা ইন ইউনানী মেডিসিন এন্ড সার্জারী ডিইউএমএস, ডিপ্লোমা ইন আয়ুর্বেদিক মেডিসিন এন্ড সার্জারী ডিএএমএস, ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ফ্যাকাল্টি ডিএমএফ ডিপ্লোমা ডিগ্রি পরিচালিত হতো না। আইন দ্বারা বলবৎকৃত সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় (হোমিও বোর্ড, ইউনানী এন্ড আয়ুর্বেদিক বোর্ড, বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) এসকল ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসকদের নিবন্ধন করারও প্রয়োজন হতো না।

দ্বিতীয় কথা এ্যালোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক, ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ডিপ্লোমা চিকিৎসক পেশাজীবীদের আলাদা আলাদা পেশাজীবী সংগঠন রয়েছে। নিবন্ধনকৃত যে কোন পেশাজীবী সংগঠন তাদের নিজ নিজ পেশাজীবী টাইটেল (যেমন; এ্যালোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক, ইউনানী, আয়ুর্বেদিক- ডিপ্লোমা ডাক্তার) প্রভৃতি ব্যবহার করতে পারেন, এজন্য আইনানুগ কোন জটিলতা নেই। নিবন্ধনকৃত পেশাজীবী সংগঠনের এরূপ ক্ষমতা ভোগ করার অধিকার দেশের প্রচলিত সকল আইন সমর্থন করে। যা সাংবিধানিক ভাবেও সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত।

হ্যাঁ, আরেকটি কথা কিছু গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক প্রতিহিংসায় বশবর্তী হয়ে ডিপ্লোমাধারীদের ডিপ্লোমা চিকিৎসক মানতে চান না, উদাহরণ হিসেবে তারা না জেনে বুঝেই বলে থাকেন এধরনের ডিপ্লোমা চিকিৎসক টার্ম কোথাও নেই। এতেকরে ডিপ্লোমাধারীরা ডিপ্লোমা চিকিৎসক পরিচয় না দিয়ে সরাসরি চিকিৎসক পরিচয় দেন। যার কারণে চিকিৎসকদের ক্যাটাগরি ডিপ্লোমা, গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোনটিই প্রতীয়মান হয় না। অতএব গ্র্যাজু্য়েট চিকিৎসকদের এধরনের বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার করা উচিত নয়। তাতে সমস্যার সমাধান তো নয়-ই বরং সমস্যা আরো বেড়ে যায়।

ডিপ্লোমা চিকিৎসকতা পেশা একদিনে গড়ে উঠেনি। কয়েকজন স্বীয় স্বার্থবাদী ও নিমকহারামীদের জন্য এর অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে না।

প্রত্যেক শাস্ত্রের প্রত্যেক ক্যাটাগরির চিকিৎসকদের মনে রাখতে হবে যে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, নাতো আইন দ্বারা বলবৎকৃত কোনো সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। জোর করে কারো উপর আইন চাপিয়ে দেয়া যায় না। আইনের চোখে সবাই সমান। মহামান্য সংবিধানের চেয়ে বড় কোন আইন গণপ্রজাতন্ত্রে নেই। প্রজাতন্ত্রে মৌলিক অধিকার হরণ করার সাধ্য কারো নেই।

লেখক : ডা. এম. মিজানুর রহমান (জনস্বাস্থ্যবিদ)

ডিপ্লোমা চিকিৎসক পেশাজীবী লিডার।
পোস্ট গ্র্যাজুয়েট জনস্বাস্থ্যবিদ পেশাজীবী লিডার।
আইন শাস্ত্রের শিক্ষার্থী ও সুলেখক।