করোনা চিকিৎসায় ঔষধ, গবেষণা ও বাস্তবতা

Emon Emon

Chowdhury

প্রকাশিত: ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ, মে ১৪, ২০২০

ডা: রিফাত আল মাজিদ :

করোনাভাইরাসজনিত রোগ নিরাময় করার স্বীকৃত কোন ওষুধ এখনো নেই। স্বস্তির বিষয় শতকরা ৮০ থেকে ৯০ জন করোনা রোগীর লক্ষণ-উপসর্গ মৃদু থেকে মাঝারি কিংবা তেমন কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না। কিন্তু ৫ থেকে ১০ শতাংশ রোগীর তীব্র মারাত্মক জীবন-সংশয়ী লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। এদের জন্য কার্যকরী ওষুধ জরুরীভিত্তিতে দরকার।
পরিকল্পিত সাপোর্টিভ কেয়ার বা লক্ষণ-উপসর্গ উপশম করা এখানে প্রধান ভূমিকা পালন করছে।
নতুন ওষুধ বের করার চেষ্টা জারি রয়েছে। এই মুহূর্তে নতুন ওষুধ বের করার জন্য প্রায় ৩০০ ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে।

কিন্তু করোনা ঝড়ে তো পুরো দুনিয়া বিপর্যস্ত এবং স্থবির। অবিলম্বে একটি সুনির্দিষ্ট কাজের ওষুধ দরকার যেটা দিয়ে করোনার চিকিৎসা করা যাবে। এমন ওষুধ র‍্যান্ডমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়ালের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার জন্য সময় দরকার। সে সময় মিলছে না। তাই অনেক ওষুধ প্রমাণিত না হলেও ব্যবহার করা হচ্ছে। করোনা একটি ভাইরাসজনিত রোগ এবং আক্রান্ত ১০০ জনের মধ্যে ৮০ কিংবা ৯০ জন কোন ঝামেলা ছাড়াই সুস্থ হয়ে যাবেন; তারা থানকুনি পাতার রস খেলেও ভাল হবেন, না খেলেও সুস্থ হবেন। সুতরাং পরীক্ষাধীন ওষুধ খেলেও ভাল হতে পারেন, না খেলেও ভাল হতে পারেন। মূল প্রশ্ন হচ্ছে যে ওষুধটিকে কার্যকর বলে দাবী করা হচ্ছে আসলে তা করোনা ভাইরাসকে শরীর ভিতরে ধ্বংস করতে পারে কিনা, গুরুতর রোগীদের জন্য কার্যকর কিনা?

ক্লোরোকুইন/হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন:
গবেষণাগারে দেখা যায় ক্লোরোকুইন ব্যবহার করলে এই ভাইরাসটির বংশবৃদ্ধি কমে যায়। এধরণের গবেষণাকে বলা হয় ইন-ভিট্রো স্টাডি (in-vitro study) । অনেক ওষুধই গবেষণাগারে কাজ করে; কিন্তু মাঠে আসল রোগীর উপর কাজ করে না।এজন্য প্রশ্ন হচ্ছে, সরাসরি করোনা আক্রান্ত রোগীকে ক্লোরোকুইন দিলে কি আসলে উপকার হয়? সেসম্পর্কে আসলে নিশ্চিত ফলাফল পাওয়ার কথা নথিবদ্ধ ছিল না। বিগত কয়েক সপ্তাহে ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন অনেক দেশেই ব্যবহার করা হয়েছে।কিন্তু নির্ভরযোগ্য কার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং র‍্যান্ডমাইজড ট্রায়ালে যে সেফটি প্রোফাইল পাওয়া গিয়েছে তা ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের ব্যবহার সমর্থন করে নাই। সর্বশেষ মতামত হচ্ছে, গবেষণাগারে করোনাভাইরাসের উপর ক্লোরোকুইনের কিছু কার্যকারিতা দেখা গেলেও বাস্তবে রোগীর শরীরে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ কিংবা নিরাময় কোন ক্ষেত্রেই এটা কাজ করে না। সুতরাং ক্লোরোকুইন নিয়ে কাড়াকাড়ি করা অর্থহীন।

লোপিনাভির/রিটোনাভির (lopinavir/ ritonavir):
লোপিনাভির প্রোটিয়েজ ইনহিবিটর জাতীয় ওষুধ। এটা আসলে এইভআইভি/এইডস রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। সংগে বুস্টার হিসেবে রিটোনাভির দেওয়া হয়। সার্স-করোনা ভাইরাসের ভিতরে প্রোটিয়েজ এনযাইমের কাজ করে। এই এনযাইম কাজ না করলে ভাইরাস আর বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। র‍্যান্ডমাইজড ট্রায়ালে ওষুধ দুটি অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। অতএব এদুটো ওষুধ আমাদের কোন আশার আলো দেখাতে পারছে না।

ফ্যাভিপিরাভির (favipiravir):
ফ্যাভিপিরাভির একটি অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ। এটা আরএনভাইরাসের পলিমারেজ এনজাইমের কাজ বন্ধ করে দেয়। অতীতে ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ অনেক আরএনএ ভাইরাসের ওপর ফ্যাভিপিরাভির ভাল কাজ করার প্রমাণ রয়েছে। এবোলা ভাইরাসের বিরুদ্ধেও এটা ব্যবহার করা হয়েছিল। সেজন্য অনেকেই ফ্যাভিপিরাভিরের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু করোনার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ফ্যাভিপিরাভির তেমন ভাল পারফরমেন্স দেখাতে পারেনি।

রেমডেসিভির (remdesivir) :
এ মুহূর্তে রেমডেসিভির নামের ওষুধটির প্রতি সকলেরই নজর। রেমডেসিভির খুব চমকপ্রদ উপায়ে কাজ করে। রাসায়নিক গঠনগত বিচারে এটা “নিউক্লিওসাইড অ্যানালগ; অর্থাৎ বলা যায় “ফেক বা নকল” নিউক্লিওসাইড। ভাইরাসের রেপ্লিকেশনের জন্য যে নিউক্লিওসাইড দরকার, সেখানে এই “ফেক বা ভেজাল”নিউক্লিওসাইড ঢুকিয়ে দিলে আসল নিউক্লিওসাইড না পাওয়ার ফলে ভাইরাসের রেপ্লিকেশন বন্ধ হয়ে যায়। অন্যকথায় এটা করোনা ভাইরাসের আরএনএ পলিমারেজ এনজাইমের কাজ ব্লক করে দিয়ে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি হতে দেয় না। এর আগে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস, এবোলা ভাইরাস, মার্গবার্গ ভাইরাস এবং মার্স ভাইরাসের চিকিৎসায়ও রেমডেসিভির ব্যবহার করা হয়েছিল। যাহোক এপর্যন্ত ট্রায়ালে রেমডেসিভির কিছুটা হলেও কাজ করছে, এমন প্রমাণ মিলেছে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (এফডিএ) গিলিয়াড সায়েন্স (Gilead Sciences, Inc.) কোম্পানীর তৈরী রেমডেসিভির (remdesivir)-কে কোভিড-১৯-এর চিকিৎসায় জরুরী ভিত্তিতে ব্যবহারের (EAU) অনুমোদন দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী অনেক কোম্পানী ওষুধটিকে মার্কেটিং করার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের “ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস” এবং আরও অনেক দেশে কোভিড-১৯ এর রোগীদের নিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে পরীক্ষা করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক পরীক্ষায় তারা কোভিড-১৯ রোগীদের দুইটা গ্রুপে ভাগ করে এক ভাগকে রেমডেসিভির দিয়ে চিকিৎসা করেছেন, আরেক গ্রুপকে রেমডেসিভির ছাড়া সাধারণভাবে চিকিৎসা করেছেন। দুই গ্রুপের মাঝে রেমডেসিভির দেওয়া গ্রুপ গড়ে ১১ দিনে সুস্থ হয়েছেন আর অন্য গ্রুপ গড়ে ১৫ দিনে। দুই গ্রুপ থেকেই রোগী মারা গিয়েছেন এবং রেমডেসিভির দিয়ে মৃত্যুর হার কমানোর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত পাওয়া গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, এই ওষুধ মৃত্যুহার কমায়, এমন কোনো প্রমাণ নেই। শুধুমাত্র যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরেছে, তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়ার সময়টা গড়ে চার দিন কম লেগেছে। গবেষণার ফলাফল এখন পর্যন্ত কোন জার্নালে প্রকাশিত হয়নি; প্রস্তুতকারী কোম্পানীর প্রেস বিজ্ঞপ্তি এবং মৌখিকভাবে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে এ বিষয়ে আরও বর্ধিত আকারে পরীক্ষা করার সুপারিশের কথা জানানো হয়েছে। এর আগে চীনেও কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় রেমডেসিভির ব্যবহার করা হয়েছিল। চীনা বিজ্ঞানীরা সন্তোষজনক ফল পান নি। কিন্তু তারা ওষুধটি যথেষ্টসংখ্যক রোগীর ওপর প্রয়োগ করার সুযোগ পান নি।

সুতরাং আমাদের মনে রাখতে হবে যে, রেমডেসিভির শুধুমাত্র “এমারজেন্সি ব্যবহারের” জন্য অনুমোদন পেয়েছে। যেসব, রোগীর ক্ষেত্রে আশঙ্কাজনক লক্ষণ দেখা যাবে, বিশেষ করে তীব্র শ্বাসকষ্ট এবং শরীরে অক্সিজেন কমে যাচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এটা ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু, এটার দীর্ঘ মেয়াদী নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে এখনও যথেষ্ট তথ্য জানা নেই, তাই শুধু করোনা পজিটিভ হলেই এটা ব্যবহার করা সমীচীন নয়।
নিটাজোক্সানাইড (Nitazoxanide):
মূলত বিভিন্নধরণের ডায়রিয়া এবং পেটের পীড়ায় নিটাজোক্সানাইড ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে ইনফ্লুয়েঞ্জা, প্যারা-ইনফ্লুয়েঞ্জা, রোটা ভাইরাস এবং নরোভাইরাসের বিরুদ্ধেও এটা কাজ করে বলে প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু এখনও কোন র‍্যান্ডমাইজড ট্রায়ালের রিপোর্ট পাওয়া যায় নি।
ইভারমেক্টিন (ivermectin):
মানুষের খোস-পাচরা বা স্কেবিস রোগের চিকিৎসায় ইভারমেক্টিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আরও অনেক প্যারাসাইটের চিকিৎসায় এর ব্যবহার রয়েছে। অ্যান্টিভাইরাল হিসেব ইভারমেক্টিনের ভূমিকা আলোচনায় আসে এইচআইভি/এইডসের চিকিৎসায়। এটা এইচআইভি/এইডস ভাইরাসের রেপ্লিকেশন বন্ধ করতে পারে। এরপরে দেখা গেল গবেষণাগারে অন্য আরও অনেক ওষুধের মত ইভারমেক্টিন করোনা ভাইরসের বংশবৃদ্ধি কমাতে পারেএবং প্রতিরক্ষা কোষের আক্রমণের মুখে ভাইরাসকে পালিয়ে যেতে দেয় না। এজন্য অনেকে আশা করছেন মানুষের শরীরের ভিতরেও ইভারমেক্টিন কাজ করবে। অতীতে ব্রাজিলে জিকা ভাইরাসের বিরুদ্ধে এবং থাইল্যান্ডে ডেঙ্গি ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইভারমেক্টিনের কোন সাফল্য প্রমাণিত হয় নি। কিন্তু করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখনও কোন র‍্যান্ডমাইজড ট্রায়ালের ফলাফল জানা নেই।
এরকম অবস্থায় করোনা মহামারী আসলেই আমাদের কাছে একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ।
এখন পর্যন্ত করোনার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রমাণিত কৌশল হচ্ছেঃ স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক নিয়ম কানুন মেনে চলা।
চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য করোনা রোগী দেখা এবং সেবা দেওয়া একটি চ্যালেঞ্জ। এরজন্য হাসপাতালের বিশেষ ব্যবস্থাপনা এবং নিজেদের সুরক্ষার জন্য প্রতিরোধমূলক পোশাক পরা জরুরী। এর কোন বিকল্প নেই।
(তথ্যসূত্র: WHO,FDA, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, অধ্যাপক সাইফুদ্দিন একরাম)

ডা. রিফাত আল মাজিদ
মেডিকেল জার্নালিস্ট

আপনার মতামত দিন :