ভ্যাক্সিন, এন্টিজেন ও এন্টিবডি নিয়ে বেসিক ধারনা

প্রকাশিত: ২:০২ অপরাহ্ণ, মে ১৯, ২০২০

লেখক: ডা.মাওলানা ইসমাইল আজহারী,ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ

ভ্যাক্সিন এর ধারনা পেতে হলে আগে এন্টিজেন ও এন্টিবডির একটা ধারণা লাগবে
তাহলে ভ্যাক্সিন বুঝতে সহজ হবে।

এন্টিজেন কাকে বলে?
এন্টিজেন হচ্ছে ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ও অন্যান্য
জীবানুর দেহ_কোষের কিছু প্রোটিন উপাদান, কিংবা এমন কোনো বস্ত যা শরীরের নিজস্ব গঠন থেকে আলাদা প্রকৃতির, কিংবা কোনো ফরেন উপাদান,
কিংবা শরীরের জন্য কোনো অপরিচিত বস্ত, যেমন
কোনো টক্সিন, ক্যামিকেল, ড্রাগস ইত্যাদি
যা দেহে প্রবেশ করলে ইমিউন সিস্টেম প্ররোচিত হয়ে এন্টিবডি তৈরী হয়, এবং ওই এন্টিবডি, অনুজীবের কিংবা এন্টিজেনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শরীর কে
মুক্ত রাখে।বভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া কিংবা ক্ষুদ্র অনুজীব গুলির দেহকোষের প্রোটিন উপাদান এন্টিজেন হিসাবে বিবেচিত হয়, এবং এই গুলি শরীরে রোগ তৈরী তে ভূমিকা রাখে।

এন্টিবডি:
এন্টিবডি হচ্ছে এক প্রকার প্রোটিন, যা শ্বেত রক্ত কণিকার বি-লিম্পোসাইট থেকে তথা রক্তের প্লাজমা সেল থেকে উৎপন্ন হয়, যখন শরীরের অভ্যান্তরে কোনো এন্টিজেন প্রবেশ করে, উদাহরণস্বরূপ ভাইরাস, কিংবা ব্যাক্টেরিয়া কিংবা ফানজাই, তখন তাকে নিউট্রালাইজড করার জন্য শ্বেত রক্তকণিকার
বি-লিম্পোসাইট থেকে এক প্রকার প্রোটিন উপাদান তৈরি হয়, যা ওই ভাইরাস কিংবা ব্যাক্টেরিয়াকে ধ্বংস করে দেয়, এবং ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শরীর কে সুরক্ষা দেয়, যাকে এন্টিবডি বলে। এইভাবে এন্টিজেনের প্রভাবে শরীরের অভ্যান্তরে এন্টিবডি তৈরী হবার প্রকিয়াকে ইমিউন রেসপন্স বলে।

একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরেকটু সহজ হবে,
মনে করুন, ডেঙ্গু একটা ভাইরাস (অনুজীব)
এই ভাইরাস যখন মশার কামড়ের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে, তখন এই ভাইরাস এর এন্টিজেন সমূহের প্রভাবে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এক
প্রকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করার জন্য উত্তেজিত হয়, এবং এই ডেঙ্গু ভাইরাস কে ধ্বংস করার জন্য
এক প্রকার এন্টিবডি তৈরী করে, যা ডেঙ্গু ভাইরাস কে
ধ্বংস করে শরীরকে সুরক্ষা দেয়। এখন ডেঙ্গু ভাইরাস কে যদি আমরা শরীরের শত্রু হিসাবে বিবেচনা করি,
তাহলে এন্টিবডি হচ্ছে শরীরের অভ্যান্তরীন এক প্রকার সেনাবাহিনি, যেই সেনাবাহিনির কাজ হচ্ছে শত্রুকে
ধ্বংস করে শরীরকে সুরক্ষা দেওয়া। এই সেনাবাহিনি তখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মধ্যে এক প্রকার মেমোরী তৈরি করে,, ভবিষ্যতে কখনো সেই একই প্রজাতির ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে সেনাবাহিনি বা মেমরি সেল তাদের কে চিনে ফেলে, এবং সাথে সাথে তাদের কে ধ্বংস করে দেয়।

প্রতিটি অনুজীবের এন্টিজেন সমূহ সুনির্দিষ্ট, এক অনুজীবের এন্টিজেনের সাথে অন্য অনুজীবের এন্টিজেনের কোনো মিল নাই। প্রতিটি এন্টিজেনের
বিরুদ্ধে কার্যকর এন্টিবডির কাজও সুনির্দিষ্ট,
যেই এন্টিবডি যে প্রকারের এন্টিজেনের উত্তেজনায়
তৈরী হয়েছে, সেই এন্টিবডি কেবল সেই এন্টিজেন কে ধ্বংস করবে।

ভ্যাক্সিন কি?

এতক্ষণে আমরা জানতে পেরেছি যে, যে কোনো ভাইরাস কিংবা ব্যাক্টেরিয়া তথা যে কোনো অনুজীবের গায়ে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রোটিন উপাদান থাকে, যাকে এন্টিজেন বলে, এবং যার প্রভাবে এন্টিবডি তৈরী হয়ে শরীরকে প্রোটেকশন দিয়ে থাকে। এখন যদি কারো রোগ হবার আগে আমরা তার শরীরের ভিতর বৈজ্ঞানিক উপায়ে সেই ভাইরাস কে রোগ সৃষ্টিতে অক্ষম করে ইঞ্জেকশন এর মাধ্যমে কিংবা মুখ দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দিতে পারি, কিংবা সেই ভাইরাস কে অকার্যকর (inactivated) করে প্রবেশ করিয়ে দিতে পারি, তাহলে সেই ভাইরাস মানুষের শরীরে ডুকবে ঠিকই, কিন্ত যেহেতু আমরা ওই ভাইরাস কে রোগ তৈরিতে অক্ষম করে ফেলেছি, তাই ভাইরাসটি শরিরে প্রবেশ করানোর ফলে শরীরে কোনো রোগ তৈরী হবেনা, তবে ভাইরাসের গায়ে যেই এন্টিজেন ছিলো, তার উত্তেজনায় শরীরের অভ্যান্তরে সেই এন্টিজেনের বিরুদ্ধে এক প্রকার এন্টিবডি তৈরী হবে,
এবং মেমোরি সেল তৈরী হয়ে শরীরের অভ্যান্তরে দ্বীর্ঘদিনের জন্য থেকে যাবে, ভবিষ্যতে যদি পরিবেশ থেকে নাক দিয়ে কিংবা মুখ দিয়ে কিংবা অন্য যে কোনো উপায়ে ওই প্রজাতির ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে, তাহলে সেই ভাইরাস কোনো রোগ তৈরি করতে পারবেনা, কারণ ভাইরাস প্রবেশ করার সাথে সাথে পুর্বে তৈরি হওয়া মেমোরি সেলের সহায়তায় এন্টিবডি সমূহ সেই ভাইরাস কে চিনে ফেলবে, এবং ভাইরাস কে
ধ্বংস করে দিবে। রোগ তৈরী হতে দিবেনা।

সুতরাং ভ্যাক্সিন হচ্ছে এক প্রকার জৈব রাসায়নিক উপাদান যা বিভিন্ন জীবানুকে যথা ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়াকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে রোগ সৃষ্টিতে অক্ষম করে তৈরী করা হয়, এবং তা ইঞ্জেকশন এর মাধ্যমে
কিংবা মুখে খাইয়ে শরীরে প্রবেশ করানো হয়, এবং তা
ইমিউন সিস্টেম কে উত্তেজিত করে এন্টিবডি তৈরি করে, এবং সেই নির্দিষ্ট প্রজাতির ভাইরাস কিংবা ব্যাক্টেরিয়া দিয়ে ভবিষ্যতে রোগ তৈরিতে বাধা প্রধান করে থাকে।

ভ্যাক্সিনের প্রকারভেদঃ
ভ্যাক্সিনকে প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত করা হয়ে থাকে,
১।লাইভ ভ্যাক্সিন:-
এই প্রকারের ভ্যাক্সিন এর মধ্যে অনুজীব সমূহ জীবিত থাকে, তবে তাদেরকে বিভিন্ন ধাপে ধাপে সেন্ট্রিফিউজ করে রোগ তৈরিতে পরিপূর্ণ অক্ষম করে দেওয়া হয়, এর পর তা শরীরে প্রবেশ করানো হয়, শরীরে প্রবেশ করালে জীবানু গুলি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে উত্তেজিত করে, এবং এন্টিবডি তৈরি করে, যেই এন্টিবডি শরীরে তৈরি হয়ে ভবিষ্যতে এই প্রকারের অন্যান্য ভাইরাস থেকে শরীরকে সুরক্ষা দেয়। যথা,
পোলিও ভ্যাক্সিন, বিসিজি ভ্যাক্সিন ।

২। নিহত/নিষ্ক্রিয়কৃত ভ্যাক্সিন (Killed vaccine) :
এই প্রকারের ভ্যাক্সিন তৈরিতে অনুজীব সমূহ
কে মেরে ফেলা হয়, মেরে তাদেরকে ইঞ্জেকশন এর মাধ্যমে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে শরীরে প্রবেশ করানো হয়, এবং তাদের গায়ের এন্টিজেনের প্রভাবে এন্টিবডি তৈরি হয়, এবং শরীরকে সুরক্ষা দেয়,
যথা:-কলেরা ভ্যাক্সিন, হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন ইত্যাদি

৩।টক্সয়েড ভ্যাক্সিন:- যেখানে ব্যাকটেরিয়ার কেবল টক্সিন গুলিকে নিষ্ক্রিয় করে রোগ তৈরিতে অক্ষম করে শরীরে পুশ করা হয়, এবং তা রোগ প্রতিরোধ করে,
যথা, টিটেনাস টক্সয়েড।

#ভ্যাক্সিন_উৎপাদন_পদ্ধতি
আমি এখানে ২০০৯ সালে আবিষ্কৃত সোয়াইন ফ্লু ভ্যক্সিন তৈরির কিছু সামারি দিচ্ছি, তাহলে ভ্যাক্সিন উৎপাদন পদ্ধতি বুঝতে সহজ হবে।

প্রথমত যেই রোগের ভ্যাক্সিন তৈরী করা হবে, সেই রোগের জীবানুকে চিহ্নিত করা হয়, ধরা যাক,
সোয়াইন ফ্লু এর ভ্যাক্সিন তৈরি হবে, তাই সর্বপ্রথম
WHO তথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত ল্যাবরেটরি
থেকে সোয়াইন ফ্লু রোগের জীবানু ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস
(H1N1) চিহ্নিত করা হয়, এবং এই ভাইরাস সমূহকে
মুরগির ডিমের ভিতর পুশ করা হয় হাইব্রিড পদ্ধতিতে
চাষ করার জন্য, এতে করে প্রতিটি ডিমে লক্ষাধিক ভাইরাস উৎপাদিত হয়, একটি ডিম থেকে একজনের ভ্যাক্সিন উপাদান তৈরি হয়, এইভাবে প্রায় ৩০০ কোটি
ডিমের মধ্যে হাইব্রিড পদ্ধতিতে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের
চাষ হয়, এবং ডিম গুলি হার্ভেস্টিং করে ভাইরাস সমূহ
ডিমের থেকে পৃথক করা হয়, এবং সেন্ট্রিফিউজ করে
ভাইরাস সমূহকে নিষ্ক্রিয় করা হয়, সেখান থেকে কিছু ভাইরাস কে ক্যামিকেল দিয়ে মেরে ফেলা হয়, এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা থেকে Killed vaccine তৈরি হয়, এবং ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে তা শরীরে পুশ করা হয়, এবং হার্ভেস্টিং পদ্ধতি কিছু ভাইরাস জীবিত রাখা হয়, তবে তা রোগ তৈরিতে অক্ষম করে নেওয়া হয়, এবং তা থেকে লাইভ ভ্যাক্সিন (Live attenuated vaccine) তৈরি হয়, এবং তা Nasal Spray হিসাবে শরীরে পুশ করা হয়। সোয়াইন ফ্লু ভ্যাক্সিনের এই
সব প্রক্রিয়া, ক্লিনিকাল ট্রায়াল হয়ে বাজারজাত হতে প্রায় ৬ মাস সময় লেগেছিলো। উল্যেখ্য,
সোয়াইন ফ্লুতে ২০০৯ সালে প্রায় ১২০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলো, আমেরিকাতেই আক্রান্ত হয়েছিলো
৬০ মিলিয়ন তথা ৬ কোটি মানুষ, সর্বোমোট মারা গিয়েছিলো ৫ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ। পরে খুব দ্রুত ৬ মাসের মধ্যে সোয়াইন ফ্লু ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়ে তা ক্লিনিকাল ট্রায়াল সফল হয়ে মার্কেটে আসে। ভ্যাক্সিনের ইতিহাসে এইটাই ছিলো দ্রুততম আবিষ্কার।

সোয়াইন ফ্লুর মত যদি করোনা ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়,
তবে তা মার্কেটে আসতে ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগতে পারে ইনশা-আল্লাহ।

ডা.মাওলানা ইসমাইল আজহারী,01640808549

 

 

আপনার মতামত দিন :