করোনা থেকে সুস্থ হয়ে সেই দিনগুলোর বর্ণনা দিলেন ঢামেক নার্স Emon Emon Chowdhury প্রকাশিত: ১১:০৫ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৩, ২০২০ কী ভয়ংকর যন্ত্রণা। বুকের ওপর যেন কয়েক মন ওজনের বড় পাথর। বেঁচে থাকার জন্য শুধুই প্রয়োজন অক্সিজেন। ভীষণ মন খারাপ হচ্ছিলো আমার দুই বছর এবং ছয় বছরের দুই সন্তানের জন্য। বড় বাবুটা ভিডিও কলে ফোন দিয়ে প্রতিদিন কান্না করতো। সে বলতো মামনি তুমি কখন আসবা? মা তোমাকে ছাড়া আমার ঘুম আসে না। কিন্তু আমি তো বলতে পারতাম না আমি কখন আসবো। কেননা আমার তো প্রতিদিন পার হচ্ছে অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে। এমনকি আমার জানা ছিল না এর শেষ কোথায়! করোনাভাইরাস থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া এক নার্স শুক্রবার দুপুরে মেডিভয়েসের কাছে এভাবেই বর্ণনা দেন তার আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশনে থাকার অভিজ্ঞতা। তিনি ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের সিনিয়র নার্স মিনাক্ষী রাণী। তিনি বলেন, ভীষণ যন্ত্রণায় শুধু চোখের কোণে পানি বেয়ে পড়তো। তাদের কান্না, আকুতি আর প্রচণ্ড যন্ত্রণায় নিজের চারপাশ ধূসর হতে লাগলো। এখনও পরিবাররের সদস্যদের জন্য খুব ভয় হয়। তারা কোয়ারেন্টিনে। রাতে বেলায় শিশুরা কাশি দিলে ঘুম ভেঙে যায়। ভয় পাই চিকিৎসক হাজব্যান্ডকে নিয়ে। তাঁর হাইপারটেনসিভ ও ডায়াবেটিস আছে। আমি আর চাই না দেশের একটি মানুষও এই ভয়ংকর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এমনকি আমার চরম শত্রুর যেন আক্রান্ত না এ ভয়ংকর এ ভাইরাসে। হাসপাতালের থাকা সময়গুলো নিয়ে মিনাক্ষী রাণী বলেন, হাসপাতালের সময়গুলো খুবই মর্মান্তিক ছিল। আমি একজন মা, সন্তানরা কাঁদছে। আর আমি চরম অসুস্থ। আর আসইশোলেসন মানেই তো একা থাকা। আমি কাউকেই কাছে পাচ্ছি না। আসলে ওই সময় শরীরের যে অবস্থা হয়, তা কখনো বলে বুঝানো যাবে না। তীব্র ব্যথা হচ্ছিল। শ্বাস নিতে না পারার যন্ত্রণা যে কতটা কঠিন, তা ওই সময়গুলোইতে বুঝেছি। তখন ব্রেইন সঠিকভাবে কাজ করছিলো না। তারপরও আমি নিজেকে ঠিক রাখার জন্য কখনো অক্সিজেন নিচ্ছি আবার কখনো নেবুলাইজার নিচ্ছি। শরীরের অস্থিরতা বেড়ে গিয়েছে। আসলে এটা নতুন একটা ভাইরাস। এ ব্যাপারে চিকিৎসকরাও বিস্তারিত জানি না। তিনি আরো বলেন, সুস্থ থাকতে অক্সিজেন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ আমরা তা বুঝি না। তখন অমি বুঝেছিলাম। আমি কথা বলতে পারছিলাম। অনেকে ফোন করে বলতেন মানসিকভাবে দৃঢ় থাকতে, এ কথা শোনলে আমার খুব রাগ হতো। আসলে এ লড়াইয়ে যোদ্ধা একমাত্র আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেই। আমি একা লড়াই করেছি। এ ভাইরাস দূরে ঢেলে দেয় সব আপনজনকে। যন্ত্রণার মধ্যেও নিজেকে মানসিকভাবে দৃঢ় রাখার চেষ্টা করেছি। আমি বলবো স্রষ্টার দয়া না থাকলে কখনো কেউ সে অবস্থা থেকে ফিরে আসতে পারবে না। আমার কাছে মনে হয় আমি অনেক লাকি। ওই রকম অচেনা, অজানা এক ভাইরাস থেকে ঈশ্বর আমাকে সুস্থতা দান করেছেন। আক্রান্ত হওয়ার বিষয় নিয়ে রাণী বলেন, যেহেতু আমি ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের ইর্মাজেন্সিতে বিভাগে ডিউটি করি। সেখানে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী আসে। আসলে সেবাই তো আমাদের ব্রত। ঘরে বসে থাকা আমাদের মানায় না। তাই ছুটে এক রোগী থেকে অন্য রোগীর কাছে। কখন যে কার কাছ থেকে ভাইরাস আমার শরীরে সংক্রমণ করেছে, তা তো জানি না। ২১ মার্চ হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরার পর, হঠাৎ করে আমার ভয়েস ডাউন হয়ে গেছে। কথা বলতে পারছিলাম না। খুব কষ্ট হচ্ছিলো। ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পরেই আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে। তখন খুব খারাপ লাগছিলো। আর আমার হাজবেন্ডও বাসায় নাই। তিনি ডিউটিতে। তখন আমার হাসপাতালের ইনচার্জ লেয়াকত ভাইকে কল দিয়ে বললাম, রাতের বেলায় যদি আমার কোন সার্পোট লাগে আমাকে একটু হেল্প করতে। তিনি হাসপাতালের (ঢামেক) পরিচালককে কল দিয়ে বিষয়টা জানিয়েছেন। স্যার ভীষণ আন্তরিকতার সাথে আমাকে প্রত্যেকটা মুর্হূতে সার্পোট দিয়েছেন। দুইদিন পর আইইডিসিআর আমাকে জানায় করোনা রিপোর্ট পজিটিভ। শোনার পর নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করেছি। মানসিকভাবে দৃঢ় রাখার চেষ্টা করেছি। তারপর আস্তে আস্তে শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে। অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। তারপর ২২ তারিখ থেকে ৩১ তারিখ হাসপাতালে ছিলাম। হাসপাতালের প্রতিটি মুর্হূত, যেন কতশত বছর! ঢামেকের সিনিয়ির নার্স মিনাক্ষী রাণী দেশের মানুষের উদ্দেশে বলেন, অমি সবাইকে বলবো, সরকার চাচ্ছে করোনাভাইরাস দেশে ছড়িয়ে যাতে না পড়ে। আমাদের জন্যই আমাদের সুস্থ থাকতে হবে। আপনার সরকারের নির্দেশনা মেনে চলুন। বেশি দিন না, অল্পকিছু দিন আপনারা ঘরে থাকুন। কারণ, আমি অসুস্থ হয়েছি। আমি এরকম ভয়াবহ একটা সময় পার করে এসেছি, এটা কতটা কষ্টের যার হবে সে ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। আমার বয়স মাত্র ত্রিশ পার হলো। তারপরও আমাকে চরম শ্বাসকষ্ট সহ নানান সমস্যায় ভূগতে হয়েছে। একটু অক্সিজেনের জন্য, একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য যে কতটা কষ্ট হতে পারে তা আমিই বুঝি। এরকম অবস্থা কাউকে বুঝানো সম্ভব না। আমার ছোট ছোট দুইটা বাচ্চাকে রেখে অনেক দিন হাসপাতালে ছিলাম। তাদের ওপর দিয়েও চরম পরিস্থিতি গেছে। তাছাড়া আমি যে একা অসুস্থ হয়েছি, সেটা তো না। যদি এরকম হতো আমি সুস্থ হয়ে যাবো। তাহলেও তো কোন চিন্তা ছিলো না। কিন্তু আমার ছোট ছোট দুইটা বাচ্ছা, আমার হাজব্যান্ড, বাসার কাজের দুইজন লোককেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছি। এসব ভেবে শারীরিক অসুস্থার সাথে চরমভাবে মানসিকভাবেও অশান্তিতে ছিলাম। আমি কিসে মধ্যে এসে পড়লাম। করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ফেরা নার্স স্বপ্ন দেখেন দেশের স্বাস্থ্যখাত আরো সমৃদ্ধ হবে। সেবা পাবে সব করোনা আক্রান্ত রোগী। আর নিশ্চিত হবে সবার জন্য উন্নত সেবা। তিনি আরো বলেন, আমি আরো আন্তরিকতার সাথে সেবা দিয়ে অসহায় এসব রোগীদের পাশে থাকতে চাই। আর কেউ করোনার মতো ভয়ংকর এ ভাইরাসে আক্রান্ত না হোক। আমার শারীরক অবস্থা আরো ভালো হলে, আবার ফিরে যাবো হাসপাতালে। সেবা দিবো করোনায় আক্রান্ত রোগীদের। যে ব্রত নিয়ে এ পেশায় এসেছি আমি তো হাত ঘুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। জীবনে জন্যই জীবন, মানুষের জন্যই মানুষ। আমি হয়তো খুব বেশি কিছু করতে পারবো না, অন্তত ৫ জন বা ১০ জন রোগীকেও যদি সেবা দিতে পারি, সেটাই হবে আমার সব থেকে বড় পাওয়া। কৃতজ্ঞতা জানাই, নার্সিং অধিদফতরের মহাপরিচালক, ঢামেক পরিচালক, বিএনএসহ আমার অনেক স্বজনকে যারা আমাকে সার্পোটে দিয়েছে। সবার দোয়ায় আমি আবার ফিরে এসেছি। আপনার মতামত দিন : SHARES নার্সিং সংবাদ বিষয়: