করোনাভাইরাস : পিপিই সংকটে সংক্রমণের শঙ্কায় নার্সরা Emon Emon Chowdhury প্রকাশিত: ১১:০৮ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৩, ২০২০ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে চিকিৎসকদের পাশে থেকে আক্রান্তদের অবিরাম সেবা দিয়ে যাচ্ছেন নার্সরা। তবে পর্যাপ্ত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) সংকটে সংক্রমণের শঙ্কায় রয়েছেন তারা। নার্সদের অভিযোগ, তাদের জন্য সরবরাহকৃত মাস্কগুলো করোনা প্রতিরোধক নয়। তাদের দাবি, যথাযথ সুরক্ষা সামগ্রীর অভাবে তারা আক্রান্ত হলে তাদের মাধ্যমে সকল স্বাস্থ্যকর্মীই কর্মক্ষেত্রে অরক্ষিত হয়ে পড়বেন, যা বিদ্যমান সংকটকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে। শুক্রবার (৩ এপ্রিল) সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ডে কর্মরত ও বাংলাদেশ নার্সেস এসোসিয়েশন (বিএনএ) ঢামেক শাখার সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান জুয়েল এসব শঙ্কার কথা জানান। তিনি বলেন, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সেবা দিতে গিয়ে ঝুঁকিতে আছেন চিকিৎসক-নার্সসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীরা। বিশেষ করে নার্সদেরকে সার্বক্ষণিক রোগীদের পাশে অবস্থান করে সেবা দিতে হয়। ফলে, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকতে হয় নার্সদেরকেই। এ অবস্থায় সরকারের উচিত নার্সদের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো সেগুলো আমরা (নার্স) পর্যাপ্ত পরিমান পাচ্ছি না। এটা শুধু আমাদের জন্যই নয়, সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যই এটা একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার। আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেন, আমাদের ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক মহোদয় খুবই কষ্ট করে চিকিৎসক নার্সদের জন্য পিপিইসহ মেডিকেল সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু পিপিই- মাস্কসহ কিছু সরঞ্জাম দিচ্ছে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সরঞ্জামগুলো করোনা প্রতিরোধক না। বিশেষ করে আমাদেরকে যে মাস্কগুলো দেয়া হয়েছে, সেগুলো করোনা প্রতিরোধক এন-৯৫ মাস্ক না। কিন্তু আমরা সবাই জানি যে, করোনা ইউনিটে কাজ করার জন্য এন-৯৫ মাস্ক ছাড়া অন্য কোন মাস্ক প্রযোজ্য নয়। প্রশাসনও আমাদেরকে যেরকম আশ্বাস দিচ্ছে বা বলছে, কেন জানি আমরা সেরকমটা পাচ্ছি না। এ অবস্থায় এটা আমাদের জন্য ভয়ের কারণ। তিনি আরো বলেন, ঢাকা মেডিকেলের বাইরে বিশেষ করে জেলা পর্যায়ে সেসব প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে, সেখানকার নার্সদের অবস্থা তো আরো ভয়াবহ। সেগুলোতে নার্সরা চরমভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। আপনারা যদি বিভিন্ন জায়গাগুলোতে খোঁজ নেন তাহলে দেখবেন যে, একই ওয়ার্ডে চিকিৎসকগন পিপিই পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর নার্সরা সাধারণ পোষাক পড়ে ডিউটি করছে। এই বিষয়গুলো আমাদের নজরে আসছে, আমরা এগুলো নিয়ে কথা বলছি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কেও বিষয়টা অবহিত করেছি। হাসপাতাল প্রশাসন ও জেলা সিভিল সার্জনদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, হাসপাতালে দায়িত্বপালনকারী একজন ক্লিনারকেও যদি আমরা সুরক্ষার বাইরে রাখি, তাহলে কিন্তু আমি নার্সসহ আপনারা আর সুরক্ষিত রইলেন না। আমার একজন ক্লিনার বা নার্স যদি আক্রান্ত হয় অথবা তাদের কোন একজনকেও যদি আক্রান্ত হওয়ার মতো অবস্থা করে রাখি, তাহলে চিকিৎসকসহ আপনারা কেউই সুরক্ষিত নন। সুতরাং নার্স বা অন্যান্য কর্মচারীদের প্রতি কোনরূপ বৈষম্য না করে সবাইকেই সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করুন। ঢামেকসহ দেশের অনেক হাসপাতালের প্রশাসনসহ চিকিৎসকরা আমাদের প্রতি খুবই আন্তরিক। কিন্তু কিছু কিছু হাসপাতালগুলোতে আমরা বৈষম্যের কথা শুনতে পাই। এ শুধু দুঃখজনকই না, এটা আমাদের সকলের জন্যই একটা ভয়ঙ্কর বার্তা। এদিকে, রাজধানীসহ সারাদেশে হাসপাতালে কর্মরত নার্সদের সুরক্ষায় শঙ্কা প্রকাশ করে অনতিবিলম্বে তাদের জন্য পিপিই সরবরাহ করার জোর দাবি জানিয়েছেন নার্সদের পেশাজীবী নেতারা। এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের (স্বানাপ) কেন্দ্রীয় সভাপতি ও হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট নার্সিং কলেজের সহকারী অধ্যাপক সোনালী রানী দাস বলেন, সারাদেশের নার্সরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এ অবস্থায় নার্সদের সুরক্ষা খুবই জরুরি। নার্সরা যদি কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষিত না থাকে, তাহলে তো তারা সেবা দিতে পারবে না। আমি যতটুকু জেনেছি, যেসব নার্সরা সরাসরি করোনা রোগীদের সেবায় কাজ করছেন, তাদের সবাইকে পিপিইসহ সুরক্ষা সরঞ্জাম দেয়া হয়েছে। তবে যারা অন্যান্য সাধারণ রোগীদের দেবা দিচ্ছেন, তারা হয়তো পিপিই তেমনভাবে পাচ্ছেন না। আমি মনে করি, যদি এই সরঞ্জামগুলোর সংকট না থাকে তাহলে সকল নার্সদেরকেই দেয়া উচিত। তবে যদি সংকট থাকে, তাহলে অন্তত সকল নার্সদের গাউন, মাস্ক, গ্লাবসগুলো পর্যাপ্ত পরিমানে দেয়া উচিত। কারণ, ওয়ার্ডগুলোতে কে করোনা আক্রান্ত বা কার মধ্যে করোনা আছে আমরা জানি না। এ অবস্থায় যদি কারো মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় করোনা ভাইরাস থেকে থাকে, তাহলে তো তাকে সেবা দিতে নার্সরাও আক্রান্ত হবে। এমনকি নার্সদের মাধ্যমে এটা সকলের মধ্যেই ছড়িয়ে যাবে। তাই সরকারের উচিত সবাইকেই পিপিইসহ পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম দেয়া। পিপিই’র ব্যবহার নিয়ে নার্সদের কোন প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে কিনা -এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, আমরা যারা আগে থেকেই কাজ করি, আমরা তো এর ব্যবহারবিধি জানি। তবে, নতুন যারা আসছে তাদের জন্য হাসপাতালের পক্ষ থেকে এর ব্যবহারের উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। আমরা যারা জানি, আমরাও তাদেরকে দেখিয়ে দিচ্ছি। সুতরাং এ নিয়ে কোন সমস্যা হচ্ছে না। আমরা এ বিষয়গুলো খুবই সচেতনতার সাথে দেখছি। বাংলাদেশ নার্সেস এসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সেবা মহাবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ইসমত আরা পারভীন বলেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে রোগীদের সেবা দিতে নার্সদের জন্য মানসম্মত ও পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম নিশ্চিত করা হয়নি। অনেক নার্স এখন পর্যন্ত আগের পিপিই ব্যবহার করছেন। যদিও সরকার সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করার চেষ্টা করছেন। তবে অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে এগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক নার্স করোনার ঝুঁকিতে আছে। রোগীদের খুব কাছে থেকেই নার্সদের সেবা দিতে হয়। তারা যদি সুরক্ষিত না থাকে, তাহলে সেবা দান প্রক্রিয়া চরমভাবে ব্যাহত হবে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে নার্সরা অভিযোগ করছেন, কয়েকটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের বলছে নিজ উদ্যেগে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এটা কখনোই সম্ভব নয়। অধিকাংশ হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম না থাকায় নার্সরা বেশ ঝুঁকিতে আছে। রোগীকে স্যালাইন, ইনজেকশন ও ওষুধ খাওয়ানোসহ রোগীদের সব প্রয়োজনে নার্সদেরই কাছে থাকতে হয়। তাই তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা খুব জরুরি। ইসমত আরা পারভীন বলেন, আমরা জেনেছি পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম আমদানি করা হচ্ছে। কিন্তু এ সরঞ্জাম নার্সরা কবে হাতে পাবে, তা আমরা নিশ্চিত নই। আমার দাবি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করা। তা না হলে করোনা ভাইরাসের এ সংকট আরো ভয়াবহতার দিকে চলে যাবে। স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের কেন্দ্রীয় মহাসচিব ইকবাল হোসেন সবুজ বলেন, সারা বিশ্বে যেভাবে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে এবং চিকিৎসক নাসসহ সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে, এ অবস্থায় সবার মধ্যেই ভয়ভীতি থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে আমরা যেহেতু সেবাদান সংশ্লিষ্ট একটা পেশার সাথে যুক্ত, আমাদেরকে ভয় পেয়ে পিছিয়ে থাকা বা পিঁছু হটার কোন সুযোগ নেই। দেশের প্রতিটি হাসপাতালেই ডাক্তারদের পাশাপাশি নার্সরাও ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের উচিত হবে পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী দিয়ে আমাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। সরকার আমাদেরকে পিপিই, মাস্কসহ সকল ধরনের সরঞ্জামই দিচ্ছে, তবে এটা যথেষ্ট নয়। আমাদের জন্য আরো অনেক বেশি পিপিইর প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নার্সদেরকে পিপিই দেয়া হচ্ছে না বা দিলেও পর্যাপ্ত দেয়া হচ্ছে না -এমন অসংখ্য অভিযোগ আমাদের কাছে আসছে। আমি মনে করি, ডাক্তার নার্সসহ সকল পর্যায়ের কর্মচারিসহ যারা করোনা আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিত, তাদেরকে পিপিই সহজলভ্য ও প্রাপ্তিসাধ্য করে দেয়া হোক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও ডাক্তার নার্সসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের যথাযথ সুরক্ষার ব্যাপারে বলেছেন। সবমিলিয়ে আমার বক্তব্য হলো আমরা পিপিই পাচ্ছি, তবে পর্যাপ্ত চাই, যা দেয়া হচ্ছে আরো চাই। নার্সদের সুরক্ষা প্রসঙ্গে ঢামেক হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু বলেন, ডাক্তাররা যেমন রোগীদের কাছে গিয়ে সেবা করছে, তেমনি নার্দেরকেও রোগীদের কাছে যেতে হচ্ছে, পাশাপাশি থাকতে হচ্ছে। ডাক্তাররা যেমন তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ লিখে দিচ্ছে, নার্দেরকেও তেমনি তাদের কাছে যেতে হচ্ছে, ওষুধ দিতে হচ্ছে। ডাক্তারের মতো হয়তো তাকে রোগীর গায়ে হাত দিতে হচ্ছে না, কিন্তু সেবা করতে হচ্ছে। একজন ডাক্তারকে যেমন এক রোগী থেকে আরেক রোগীর কাছে যেতে হচ্ছে, তেমনি নার্দের ওয়ার্ডের সকল রোগীদের কাছে যেতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে ডাক্তারদের মতোই নার্দের সুরক্ষা সরঞ্জামের প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে তাদেরকে গ্লাবসটা বারবার বদলানো উচিত। সেজন্য তাদের জন্য প্রচুর পরিমানে পিপিই, প্রচুর পরিমানে গ্লাবস, মাস্ক এগুলো সরবরাহ করা উচিত। তিনি বলেন, সুরক্ষা সরঞ্জামের পাশাপাশি এগুলো ব্যবহারের উপরে নার্দের প্রচুর পরিমানে ট্রেনিং দরকার। কিভাবে এগুলো পড়বো, কিভাবে এগুলো খুলবো আবার কোথায় এগুলো ডিস্পোজ করবো, এগুলো নিয়ে তাদের খুব বেশি ধারনা থাকার কথা না, এজন্য তাদেরকে ট্রেংনিয়ের আওয়াত নিয়ে আসা জরুরি। এই বিষয়গুলো তারা না জানে তাহলে কিন্তু এই ভাইরাস হাসপাতালেও ছড়াবে। উল্লেখ্য, আজ দেশে আরও পাঁচজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে ৬১ জন হলো। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় কেউ মারা যাননি। ২৬ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। চিকিৎসাধীন ২৯ জন। তাঁদের মধ্যে হাসপাতালে রয়েছেন ২২ জন। বাড়িতে পূর্ণ পর্যবেক্ষণে আছেন ৭ জন। ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ১৪ জনকে আইসোলেশনে নেওয়া হয়েছে এবং ১০ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আপনার মতামত দিন : SHARES নার্সিং সংবাদ বিষয়: