৭ম শ্রেণিতে গণিত পরীক্ষায় শূন্য পাওয়া ছেলেটিও আজ একজন তরুণ উদ্যোক্তা! Emon Emon Chowdhury প্রকাশিত: ৪:০৪ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ২১, ২০২০ স্কুল জীবনের শুরু থেকেই অংকের প্রতি ভীষণ ভয় কাজ করতো। ছোটখাটো সহজ অংকগুলোকেও জমের মতো ভয় পেতাম। গণিত বই দেখলে যেন জ্বর চলে আসতো। ক্লাসে স্যারেরা অংক করানোর সময় শুধু দেখে দেখে খাতায় তুলতাম আর বুঝে না বুঝেও স্যারের উত্তরে মাথা নাড়াতাম। ২০০৪ সালের কথা আজ খুব মনে পড়ছে। তখন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়তাম। অংকের দুর্বলতার কথা চিন্তা করে বাসায় একজন শিক্ষক রাখা হলো। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথ এর স্টুডেন্ট ছিলেন। সেই সাথে পড়ালেখার ব্যাপারে খুব কড়া। অংকের পাশাপাশি আমাকে ইংরেজি, বিজ্ঞান, বাংলা ব্যাকরণ, সামাজিক বিজ্ঞান সহ সকল সাবজেক্ট ই পড়াতেন। প্রতিদিন বাড়ির কাজ দিতেন, আর প্রতিদিন তা আদায় করে নিতেন। হোমওয়ার্ক না করলে চলতো কঠিন শাস্তি। সপ্তাহের ৭ দিনের ৫ দিনই কোন না কোন বিষয়ের জন্য শাস্তি পেতে হতো। কান ধরে ১০০বার উঠাবসা করা, নীল ডাউন হওয়া, বেতের বাড়ি, কানমলা খাওয়া, থাপ্পড় ইত্যাদি যেন রুটিন মাফিক চলতো। একদিন দুর্গাপূজার সময় স্যারের শাস্তির ভয়ে বাসা থেকে বিকালে পালিয়ে পূজার মন্ডপের সামনে মেলায় ঘুরাঘুরি করছিলাম। হঠাৎ দেখি স্যার আমার পেছনে এসে হাজির। কানটা ধরে বাসায় নিয়ে গিয়ে ইচ্ছামতো উত্তম মধ্যম দিয়ে দিলো। তবে একটা সময় আস্তে আস্তে পড়ার প্রতি এক রকম ধারাবাহিক সময় দেয়ার ফলে শাস্তির পরিমাণও কমতে শুরু করলো। নিয়মিত পড়া রেডি করতে অভ্যস্ত হতে শুরু করলাম। এভাবে ধীরে ধীরে সকল বিষয়ে ভাল ফলাফল হতে লাগলো। ক্লাস ফাইভ থেকে যখন ক্লাস সিক্সে উঠি, তখন আমার রোল অনেক সামনে এগিয়ে এসেছিল। সিক্সের পরীক্ষাগুলোতে ভাল ফলাফল করা শুরু করলাম। ইংরেজি পরীক্ষায় নিয়মিত সর্বোচ্চ নাম্বার পেতাম, এমনকি অংকের মতো জমের সাবজেক্টেও একবার সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে গেছিলাম। যেটা কখনো স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারিনি। ক্লাস সিক্সের শেষের দিকে বাবার অর্থনৈতিক সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে স্যারকে বিদায় নিতে হলো। এ সময় আর কোন প্রাইভেট টিউটর রাখা হলো না। আস্তে আস্তে আমার ফলাফল খারাপ হতে শুরু করলো। সেভেনের উঠার পর একবার অংকে ১৫ পেলাম। এরপর আরেকটি পরীক্ষায় অংকে ০০ পেলাম যা নিয়ে পুরো ক্লাসে হৈচৈ পড়ে গেল। ক্লাস টিচার ক্লাসে এসে সবার সামনে আমার অংকের ফলাফল নিয়ে আমাকে ইনসাল্ট করতে শুরু করলো। কিছুদিন লজ্জায় ক্লাসও করতে পারিনি। এরপর ক্লাস সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষায় অন্যান্য বিষয়ে ভাল ফলাফল করলেও অংকে ফেল করে কোন রকমে স্যারদের রিকুয়েস্ট করে টেনেটুনে ৮ম শ্রেণীতে উঠলাম। অষ্টম শ্রেণির অভিজ্ঞতা আমার জীবনের অন্যতম একটি শিক্ষা, যা আমি আজও ভুলতে পারিনা। বাবার অার্থিক অবস্থার অবনতির কারণে প্রাইভেট টিউটর রাখা হলোনা। সেই সাথে ক্লাসের স্যারেদের কাছে কোচিং করার চাপ থাকা সত্বেও আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বল থাকায় কোচিং এ ভর্তি হই নাই। ক্লাস টিচার গণিত পড়াতেন। গণিত পরীক্ষায় ফেল করায় তিনি বারবার তাঁর কাছে কোচিং এর প্রেশার দিতেন। কিন্তু কোন উপায় ছিল না। ক্লাসে প্রায় সময় গণিত শিক্ষকের কাছে মার খেতাম। অন্যদিকে ইংরেজিতে ছিলাম যথেষ্ট ভাল ছাত্র। ইংরেজি শিক্ষক প্রতিদিন আমাকে দিয়ে সবার সামনে জোরে জোরে রিডিং পড়তেন। এছাড়া গ্রামারের বিভিন্ন বিষয় আমার কাছে জানতে চাইলে আমি খুব সুন্দর করে সঠিক উত্তর দিতাম। ইংরেজি শিক্ষক আমাকে একদিন বলেছিলেন, তোমার স্পষ্টভাষা ও শুদ্ধ উচ্চারণ তোমাকে সফল হতে সাহায্য করবে। অষ্টম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় সকল বিষয়ে মোটামুটি ভাল ফলাফল করলেও অংকে করলাম ফেল। স্কুলে নতুন এখন কড়া প্রধাণশিক্ষক আসলেন, যিনি কোন কিছুতেই ছাড় দেন না। আমাকে নবম শ্রেণীতে উন্নীত করা হলো না। আম্মুকে নিয়ে ক্লাশ টিচারের কাছে ও প্রধাণ শিক্ষকের কাছে গিয়ে অনেক রিকুয়েস্ট করলাম। ইংরেজি শিক্ষকও আমার জন্য সুপারিশ করলেন, একবার সুযোগ দেয়ার জন্য। কিন্তু ক্লাশ টিচার আমার ব্যাপারে তেমন কোন গুরুত্ব দিলেন না। অন্যদিকে উনার কাছে যারা কোচিং করতেন, তাদের অনেকেই ৩-৪ সাবজেক্ট ফেল করা সত্বেও তাদেরকে তিনি উত্তীর্ণ করার জন্য স্যপারিশ করলেন। শেষ পর্যন্ত ব্যার্থ হয়ে ক্লাস এইটে আরেকবছর থাকতে হলো। পরে বাধ্য হয়ে ক্লাশ টিচারের কাছে কোচিং এ ভর্তি হলাম। জুনিয়রদের সাথে ক্লাস করতে ভাল লাগতো না। মনটা অনেক খারাপ লাগতো। বন্ধুদের কাছে মুখ দেখাতে পারতাম না। অনেক বেশি ডিপ্রেশনে ডুবে থাকতাম সারাক্ষণ। এরই মাঝে সব কিছু আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠে মোটামুটি ফলাফল করে ৯ম শ্রেণীতে উঠলাম। এরপর দেখতে দেখতে সময় কেটে গেল। SSC পরীক্ষায় অন্যান্য বিষয়ে A+/A গ্রেড পেলেও অংকে পেলাম C. যার ফলে মোট GPA 4.38 পেয়ে SSC পাশ করলাম। এরপর সরকারি IHT তে চান্স পেয়ে ডিপ্লোমা ইন ফিজিওথেরাপি কোর্সে ভর্তি হলাম। মেডিকেল সাবজেক্ট এ গণিত না থাকায় রেহাই পেলাম। আমার জীবনের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট এখানেই। এখান থেকেই আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলাম। পড়ালেখাসহ অন্যান্য ক্যারিকুলার একটিভিটি’তে প্রশংসা অর্জন করতে শুরু করলাম। ২০১৫ সালে ডিপ্লোমা পাশের পর ভাল একটি প্রতিষ্ঠানে রোগিদের সুচিকিৎসা দেয়া শুরু করলাম। একটা সময় স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের জন্য কয়েকজন বন্ধু ও ছোট ভাইদের সাথে নিয়ে “অর্পণ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ” নামক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিয়ে কাজ করা শুরু করলাম। বর্তমানে অন্যান্য সংগঠনের পাশাপাশি অর্পণ ফাউন্ডেশন ও ভাল আস্থা ও প্রশংসা অর্জন করে চলেছে। নিয়মিত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচী সহ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী কাজে অবদান রাখছে সংগঠনের সদস্যগণ। সংগঠনের বয়স মাত্র ৪ বছর হওয়া সত্বেও অল্প সময়ে বেশ কিছু দৃষ্টান্তমূলক কাজ হয়েছে এ প্ল্যাটফর্ম এর মাধ্যমে। এছাড়া সংগঠনের নিজস্ব আধুনিক ওয়েবসাইটও আছে (www.arpanbd.org) যেগুলো অনেকের কাছেই প্রশংসিত। মানবতায় বিশেষ অবদানের জন্য অনেক সংগঠনের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে অর্পণ ফাউন্ডেশন। ২০১৬ সালে বন্ধুদের সাথে নিয়ে আমরা দেশের মেডিকেল ভিত্তিক সংবাদ প্রকাশের জন্য মেডিনিউজবিডি.কম (www.medinewsbd.com) নামক একটি বিশেষ অনলাইন নিউজ পোর্টাল তৈরি করার কাজে নেমে পড়ি। অনেক সীমাবদ্ধতা ও বাধা পেরিয়ে ২০১৭ সালে এসে এ নিউজ পোর্টালটি আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে। বর্তমানে এটি দেশের মেডিকেল ভিত্তিক অন্যতম গণমাধ্যম, যা অল্প দিনে সকলের আস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধীরে ধীরে আরো উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে মেডিনিউজবিডি.কম। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশের সর্ববৃহৎ যুব প্ল্যাটফর্ম “জাতীয় যুব সংসদ” গড়ার কাজে অংশ নেই। যেখানে আমাকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। নিজের দক্ষতা অনুযায়ী কাজ করে যথেষ্ট প্রশংসা কুড়োতে সক্ষম হই। তার স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয় যুব সংসদের অ্যাডভেঞ্চার কেবিনেট – ২০১৮ তে আমাকে “লিজেন্ড অব দ্যা ইয়্যুথ পার্লামেন্ট” হিসেবে বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয়। ২০১৮ সালে এসে শুরু থেকে বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছি। আমার পেশা ফিজিওথেরাপি’র উপর ভিত্তি করে বিশেষ কিছু উদ্যোগের প্রস্তুতি নিচ্ছি। অচিরেই তা শুরু হবে, আর সকলের সহযোগীতা পেলে এটিও সফল হবে ইনশাআল্লাহ! পরিশেষে শুধু একটি কথাই বলতে চাই, চলার পথে হোচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে, আপনি আর কখনো হাটতে পারবেন না। চলতে গেলে হোচট খেয়ে পড়ে থাকলে চলবে না, উঠে দাঁড়ান, এগিয়ে যান। পথে নেমে পড়ুন, পথই আপনাকে পথ দেখিয়ে দিবে। বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই, শুধু নিজেকে বারবার বলুন, “আজ না হয় কাল, সফল আমি হবোই”!! সাখাওয়াত হোসেন চৌধুরী (ইমন) [বিপিটি – ঢাবি (ইন কোর্স), ডিমটি (ফিজিও) – এসএমএফ] প্রেসিডিয়াম সদস্য – জাতীয় যুব সংসদ, বাংলাদেশ। সভাপতি – অর্পণ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী – মেডিবুকবিডি.কম। সম্পাদক – মেডিনিউজবিডি.কম। গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক – বঙ্গবন্ধু মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পরিষদ (বিএমটিপি) আপনার মতামত দিন : SHARES মতামত বিষয়: