সম্পর্কের টানাপড়েনে প্রবীণ জীবন

Emon Emon

Chowdhury

প্রকাশিত: ৯:৩০ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২০, ২০২০

হাসান আলী :

মানুষ সবকিছুতেই সম্পর্ক খোঁজে। রিকশাওয়ালা, চা বিক্রেতা, পান দোকানদার, তরকারি বিক্রেতা, ঝালমুড়িওয়ালা, ফেরিওয়ালাকে মামা, চাচা, ভাই বলে ডাকে। অপরিচিত বয়স্ক নারী-পুরুষকে আংকেল-আন্টি বলে। অপেক্ষাকৃত কমবয়সীদের ভাই-আপা বলে ডাকে। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে পরিচয় পর্বে আমরা সম্পর্ক নিয়ে কথা বলি। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের আলোচনায় ‘সম্পর্ক’ নিয়ে কথা হয় বেশি। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মসহ প্রায় সবকিছুতেই সম্পর্ক ভাঙাগড়ার আলোচনাই প্রধান। মানুষ সম্পর্ক রক্ষায় যতটা মনোযোগী আর কিছুতেই এতটা মনোযোগী নন। সম্পর্ক ভাঙ্গার ব্যথায় মানুষ কাতর হয়ে পড়েন এবং কেউ কেউ বিষণœতায় ভোগেন। সম্পর্কের টানাপড়েনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুর্বলরা। আমাদের সমাজে শিশু ও প্রবীণরা তুলনামূলকভাবে দুর্বল, কারণ তারা নির্ভরশীল। শিশুদের মধ্যে একটা সম্ভাবনা থাকে নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার; কিন্তু প্রবীণদের মধ্যে এ সম্ভাবনা খুবই কম। প্রবীণদের নির্ভরতা দিন দিন বাড়তে থাকে। এ নির্ভরতাকে কেন্দ্র করে পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে টানাপড়েন তৈরি হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ টানাপড়েন সুখকর হয় না। সামর্থ্যবান প্রবীণদের ক্ষেত্রে আর্থিক নিয়ন্ত্রণ কে কীভাবে করবে সেই প্রশ্নে বিতর্ক তৈরি করে।
পরিবারের অপেক্ষাকৃত তরুণরা চায় প্রবীণের ধনসম্পদ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বটুকু নিজেদের কাছে রাখতে। তাদের বেশিরভাগই মনে করেন, সহায়-সম্পদ পরিচালনা করার জন্যে দক্ষতা এবং ক্ষমতা প্রবীণের নেই। প্রবীণরা মনে করেন, তাদের সহায়-সম্পদটুকু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে পারিবারিক সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হলে মতভিন্নতা প্রকাশ্যে আসে। প্রবীণ বাবা-মা মানসিক অশান্তিতে ভোগেন। আস্তে আস্তে ছেলেমেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। সামর্থ্যহীন প্রবীণরা জীবনধারণের জন্য সন্তানের ওপর নির্ভরশীল থাকেন। সন্তানের সামর্থ্য না থাকলে প্রবীণরা কষ্টের মধ্যে পড়েন। একাধিক সন্তানের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ভরণপোষণ কে কতখানি করবে এ বিতর্ক সামনে চলে আসে। কম-বেশি করার বিতর্ক একটা সময় প্রধান হয়ে দেখা দেয়। বিতর্ক অব্যাহত থাকলে পারিবারিক কথাবার্তা এবং মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। সংসারে যে আয় বেশি করেন এবং পরিবারের প্রতি বেশি দায়িত্ব পালন করেন, তিনি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। অভিযোগের মাত্রা দিন দিন বাড়তে থাকলে তার আচরণের মধ্যে পরিবর্তন আসতে থাকে। এক পর্যায়ে অবহেলা প্রকাশ্যে চলে আসে। পরিবারের কম সামর্থ্যবান সদস্যরা প্রবীণের দেখভাল, সেবাযতœ করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। আর্থিক সহযোগিতা করতে না পারার কষ্ট সেবাযতœ করার মধ্য দিয়ে পুষিয়ে দিতে আগ্রহী হন। প্রকৃতিগত কারণেই সামর্থ্যবানরা পারিবারিক নেতৃত্বে থাকেন। তারা পরিবারের জন্যে কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তার ফিরিস্তি অন্যদের নিয়মিত শুনতে হয়। পরিবারের সদস্যদের আনুগত্যের ঘাটতি সামর্থ্যবানরা মেনে নিতে চান না।
ক্ষেত্রবিশেষ প্রবীণ বাবা-মায়ের উন্নত চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন সামর্থ্যবান সন্তানরা করে থাকেন। বাবা-মায়ের প্রতি বড় দায়িত্ব পালন করার মধ্য দিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রতি করুণার মনোভাব প্রকাশ পেলে সামর্থ্যহীন সন্তানদের মধ্যে অপরাধ বোধ জেগে উঠে। সম্পর্কের টানাটানি নতুন করে শুরু হয়। ঢাকাসহ অন্য বড় শহরগুলোতে একাকী প্রবীণের সংখ্যা বাড়ছে। কারও ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকেন কিংবা অন্য শহরে থাকেন, আবার কারও সন্তান একই শহরে অন্যত্র নিজের কিংবা ভাড়া বাসায় থাকেন। প্রবীণরা স্বাধীনভাবে নিজের বাসায় থাকতে আগ্রহী। তারা অনেকদিন ধরে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিলেন। এখন নতুন করে সন্তানের সংসারে নিয়ন্ত্রিত হতে চান না। দুইবেলা খাবার আর রাতযাপনের জন্যে সন্তানের অবহেলা-অপমান সহ্য করার ক্ষমতা অনেক প্রবীণেরই নেই। প্রবীণ শান্তিতে মর্যাদার সঙ্গে জীবনধারণে ইচ্ছুক। স্বস্তি, সম্মান, মর্যাদায় ঘাটতি প্রবীণকে অস্থির করে তোলে।

প্রবীণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, মনোমালিন্য থাকলে সন্তানরা মায়ের পক্ষ নেন। সন্তানদের চোখের সামনে ভেসে উঠে সংসারে মায়ের সীমাহীন কষ্ট আর বাবার অবহেলা। পরিবারের সদস্যরা অতীতে ঘটে যাওয়া নানা দুঃখ-দুর্দশার চুলচেরা বিশ্লেষণে আগ্রহী হয়ে উঠেন। এক পর্যায়ে কেউ একজন দোষী সাব্যস্ত হয়। ঘটে যাওয়া অপমানের প্রতিশোধ নতুন অপমানের মাধ্যমে নিতে তৎপর হয়ে উঠে। পারিবারিক অশান্তি নতুন দিকে মোড় নেয়। অতীতের বেশিরভাগ ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণই হলো প্রবীণের ব্যর্থতা আর অক্ষমতাগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। প্রবীণরা চোখের পানিতে ভাসে। ফিরে যায় হারানো দিনগুলোর কাছে। নিজের সুখ-সুবিধা, সখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে সংসারে ঘানি টেনেছেন ভবিষ্যতের সুখের আশায়। মর্যাদাহীন অসম্মানের জীবনকে তুচ্ছ মনে করতে শুরু করেন। মনের অজান্তেই একদিন প্রবীণ জীবনের দায়ভার সন্তানের ওপর দিতে চেয়েছিলেন। সামাজিক পরিবর্তনগুলো এতটা নির্মম হবে, তা কল্পনাতেই আনতে পারেননি। প্রবীণ ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের মধ্যেই নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে চেয়েছেন। আলাদা করে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবেননি। সন্তানের লেখাপড়া, বাড়ি, গাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স, ব্যবসাবাণিজ্য নিশ্চিত করতেই বেশি তৎপর ছিলেন। অনেক সময়ই নিজের শরীরের প্রতি সঠিক যতœ নেননি। বার্ধক্যের জন্যে কোনো ধরনের প্রস্তুতিও ছিল না। যে বস্তুগত অর্জনের জন্য এতটা আকুল হয়েছিলেন, তা বার্ধক্যে এসে বোঝা হয়ে গেছে। সহায়-সম্পদ থাকলেই প্রবীণ সঠিক সেবাযতœ পাবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পরিবারের সদস্যরা যদি বুঝতে পারেন প্রবীণ ব্যক্তিটিা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা কম, তাহলে আচরণে প্রভাব ফেলবে। সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা যত কম হবে চিকিৎসা খাতে ব্যয় সে পরিমাণ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

কেউ কেউ অযথা খরচ করতে অনাগ্রহী হন। এসবকে কেন্দ্র করে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে টানাপড়েন লেগে যেতে পারে। কোনো কোনো সময় প্রবীণ স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে হাত-পা অবশ হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করা যায় না, অথচ প্রবীণ ব্যক্তিটির জরুরি চিকিৎসাসেবা প্রয়োজন। স্মৃতি ক্ষয়জনিত রোগ ডিমেনশিয়া হলে একজন প্রবীণের পক্ষে সম্পত্তি হস্তান্তর বা ব্যাংক লেনদেন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। এ রকম পরিস্থিতিতে পরিবারের সদস্যরা কখনও কখনও প্রকাশ্যে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে যায়। সম্পর্ক নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে শুরু করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রবীণরা যথাযথ সম্মান, সেবাযতœ গ্রহণ করার সুযোগ পান না। খোঁজখবর করলে দেখা যাবে, সামর্থ্যবান প্রবীণের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ব্যয় তুলনামূলকভাবে বেশি। যেসব প্রবীণ পরিবারের সদস্যদের প্রত্যক্ষ সেবাযতœ গ্রহণ করেন, তারাও তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যয় করে থাকেন। অতিরিক্ত ব্যয় প্রবীণকে চিন্তিত করে তোলে। তিনি ভবিষ্যতের কথা ভেবে আরও বেশি অস্থির হয়ে পড়েন। প্রাপ্ত সেবাযতেœর মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং তুলনা করতে শুরু করেন।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রবীণকে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ব দেয়ার মনোভাব আমাদের সমাজে রয়েছে। প্রবীণরা সব ধরনের পরিবর্তনকে সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করেন। নতুন কোনো ভাবনা-পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো প্রথমেই নজরে আনেন। নবীনরা ক্ষেত্রবিশেষ এসব বিষয়ে ভিন্ন মতামত দেন। এখান থেকেও সম্পর্কের টানাপড়েন তৈরি হতে পারে। প্রবীণরা প্রায়ই শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। প্রবীণরা পারতপক্ষে নির্যাতনের কথা কাউকে বলতে চান না। নিকট আত্মীয়স্বজনরা নির্যাতনের কথা জেনে যায়। পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়স্বজনরা সুবিধামতো দিকে নিজেদের অবস্থান নেন। প্রবীণ ক্রমেই সংকটের দিকে এগিয়ে যান। সংকট মোকাবিলা করতে আবেগনির্ভর আচরণ সম্পর্ক তৈরিতে কোনো ভূমিকা রাখে না। বেশিরভাগ সময়ই প্রবীণরা ঠা-ামাথায় পরিস্থিতির বিচার-বিশ্লেষণ করতে চান না। সব ঘটনার দায় ব্যক্তিবিশেষের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় কার্যকর অংশগ্রহণ করতে না পারলে প্রবীণরা নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকেন। নিজের মধ্যে অপরাধবোধ তৈরি হয়। সংসারে নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে করতে শুরু করেন।
অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের মধ্য দিয়ে সম্পর্কগুলো ক্রমেই উষ্ণতা হারাতে থাকে। একসময় শুকনো অসুস্থ সম্পর্কগুলো নামমাত্র টিকে থাকে। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাই মুখ্য বিষয় হতে পারে না। আমাদের মধ্যে অনেকেই প্রবীণদের অনেক সম্মান-মর্যাদার চোখে দেখেন। মনে করেন তারা কোনো ভুল বা অন্যায় করতে পারেন না। সবসময়ই ন্যায়সংগত আচরণ করবেন। আমাদের গভীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা প্রবীণকে উচ্চমর্যাদায় আসীন করে। আমরা তাদের যৌনজীবনকে অবজ্ঞা করি; কিংবা লজ্জায় মুখ ঢাকি। প্রবীণের স্বাভাবিক যৌন চাহিদা রয়েছে। এ চাহিদা পূরণে পারিবারিক এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। যৌনতার সংকট প্রবীণ জীবনকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলতে পারে। আমাদের সমাজ প্রবীণের বিয়েকে অসম্মানের বিষয় বলে মনে করে। পরিবারের সদস্যরা প্রবীণকে বিয়ে দিতে অনিচ্ছুক। বিয়ের সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা পরিবারে টানাপড়েন তৈরি করতে পারে। সম্পর্ক ভাঙাগড়ার সব পর্যায়ে প্রবীণ ঝুঁকিতে থাকে। সম্পর্কের সংকট তৈরি করে প্রবীণের স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাহত করা ঠিক হবে না।

লেখক : সভাপতি, এজিং সাপোর্ট ফোরাম, ট্রেজারার বাংলাদেশ জেরোন্টলজিকেল অ্যাসোসিয়েশন।

আপনার মতামত দিন :