ভারসাম্যহীন স্বাস্থ্যবিভাগ, খেসারত দিচ্ছে দেশবাসী

Emon Emon

Chowdhury

প্রকাশিত: ১০:৫৮ পূর্বাহ্ণ, মে ১, ২০২০

দেশের তৃণমূলের অসহায় মানুষদের প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের জনগণের স্বাস্থ্যসেবাকে নিশ্চিত করার এই পদক্ষেপ বদলে দিয়েছে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে। কমিউনিটি ক্লিনিকে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট সহ সংশ্লিষ্ট কিছু পদ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সার্বিক পরিবর্তন হতে পারে। প্রতিষ্ঠা কালীন সময়ে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সে সময়ে দেশে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ স্বাস্থ্য কর্মীর অপ্রতুলতার জন্য সিএইচসিপিদের নিয়োগ দিয়ে একটা স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার দেশে বেশ কয়েকটি সরকারি হেলথ টেকনোলজি ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে এবং বেশ কিছু বেসরকারি হেলথ টেকনোলজির অনুমোদন দিয়েছে। এই স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো থেকে প্রায় ৪০,০০০ (চল্লিশ হাজার) মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পাশ করে বেকার। কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোতে যদি একজন করে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) ও ডিপ্লোমা ফিজিওথেরাপিস্ট নিয়োগ দেয়া যায় তাহলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুবিধা বঞ্চিত মানুষ কোয়ালিটি স্বাস্থ্যসেবা পাবে। ল্যাবরেটরি ফ্যাসিলিটিজ সহজ লভ্য হলে খুব দ্রুত রোগ নির্ণয় ও সুচিকিৎসা পাবে তৃণমূলের জনগণ। অসংক্রামক ব্যাধি যেমন ডায়াবেটিস, হৃদ রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, এ্যাজমা ইত্যাদি একবার আক্রান্ত হলে আর নির্মূল হয় না। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিরা অল্প বয়সেই উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে হয়ে যায় পরিবার, দেশ ও সমাজের বোঝা। নিয়মিত পরীক্ষা, ঔষধ সেবন ও নিয়ম মেনে নিয়ন্ত্রণে রেখে চলতে হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকে যদি পরীক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয় তাহলে ভুক্তভোগীরা উৎপাদনক্ষম জীবন যাপন করতে পারবে। এছাড়া গর্ভবতী মায়েদের রুটিন চেক-আপ ল্যাবরেটরি পরীক্ষা যেমন- ইউরিন আর/ই, ব্লাড গ্রুপিং, হিমোগ্লোবিন, ব্লাড গ্লুকোজ, এইচ বিএসএজি, ভিডিআরএল ইত্যাদির জন্য যেতে হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কিন্তু সেখানেও পদ গুলো শূন্য। ফলে বাধ্য হয়ে সেবাগ্রহীতারা সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে। প্রটিনিউরিয়া হলে গর্ভবতী মায়েদের প্রসবকালীন সময়ে খিচুনি, একলামশিয়া, প্রি-একলামশিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে। কিন্তু ইউরিন আর/ই এর মতো ছোট কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাটির মাধ্যামে প্রোটিনিউরিয়া নির্ণয় হলে হয়ত অসংখ্য গর্ভবতী মা প্রসবকালীন মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাবে। এছাড়া বিভিন্ন রক্তরোগে আক্রান্ত অথবা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত রক্তক্ষরণ এবং প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ রোগীদের রক্ত ও রক্তের বিভিন্ন উপাদান ট্রান্সফিউশন দেয়া হয়। আগ্রহী রক্তদাতাদের রক্তের গ্রুপ জানা না থাকার জন্য সময় মতো রক্তসংগ্রহ সম্ভব হয় না। সময় মতো রক্তদিতে না পারায় মৃত্যুর ঘটনাও নেহায়েত কম নয়। কমিউনিটি পর্যায়ে রক্তের গ্রুপ করার সুযোগ থাকলে দেশের সবাই সহজেই তার রক্তের গ্রুপ জানতে পারবে খুব সহজেই। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা দশজন শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতায় ভুগছেন। নিয়মিত সম্পূর্ণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে তাদেরকে স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে মহামারি মোকাবেলায় কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীরা রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে কাজ করতে পারবে। করোনার এই বিশাল ক্রাইসিসে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের সঙ্কট এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাংলাদেশ। কমিউনিটি ক্লিনিকের এই রিজার্ভ ফোর্স থাকলে আজ খুব সহজেই তা মোকেবেলা করা যেত। স্বাধীনতার পর দেশের জনগণ বৃদ্ধি পেয়েছে, হাসপাতালের সজ্জা সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য সবার পদ বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের পদ বৃদ্ধি পায় নি বরং এ পদে নিয়োগ হচ্ছে না এক যুগ থেকে। ফলে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো ভারসাম্যহীন হয়ে পরেছে। আর এই ভারসাম্যহীনতার কারণে দেশবাসিকে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে অনেক। খেসারত হিসেবে দিতে হয়েছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। আমরা সবাই দেখেছি ডেঙ্গু, করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্য বিভাগের অসহায়ত্ব। বাংলাদেশে লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হতে পারে বলে মন্তব্য করে দ্রুততম সময়ে করোনা মোকাবেলার জন্য প্রতি লাখে পাঁচ হাজার মানুষের নমুনা পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু ল্যাবরেটরিতে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের যে জনবল তাতে এই কর্মযজ্ঞ কোনোভাবেই সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে মেডিকেল ল্যাবরেটরি টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ না দিলে করোনা মোকাবেলা অসম্ভব। মৃত্যুর মিছিলে আরো কতো প্রাণ যোগ হলে কর্তাব্যক্তিদের বোধদয় হবে তারাই ভালো জানে। মেডিকেল ল্যাবরেটরি টেকনোলজিস্টদের প্রয়োজন ও গুরুত্ব বিবেচনায় করোনা মোকাবেলার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশ আবেদনের সময় তিন দিন বেধে দিয়ে এক সপ্তাহেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে মেডিকেল ল্যাবরেটরি টেকনোলজিস্টদের কাজে যোগদান করিয়েছে। ভারসাম্যহীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পরার আগে কমিউনিটি ক্লিনিকে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ সহ প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, টার্শিয়ারী পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান গুলোতে জনগণ বৃদ্ধির হার বিবেচনায় চিকিৎসক ও নার্সদের পদের আনুপাতিক হারে বিদ্যমান পদের কয়েকগুণ ডিপ্লোমা মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব, রেডিওলজি, ডেন্টাল, ফিজিওথেরাপ, রেডিওথেরাপি) এবং বাস্তবতা ও প্রয়োজন বিবেচনায় প্রত্যেকটি স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক থেকে দশ জন গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের পদ সৃষ্টি করে দ্রুত নিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় একটা ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

লেখক :
মোঃ সামিউল বাশির
মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব)
বিএসসি ইন হেলথ টেকনোলজি (ঢা.বি.)
সাংগঠনিক সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পরিষদ।

আপনার মতামত দিন :